সরকারি পদগুলোতে সরকারের তথ্য অনুযায়ী প্রায় চার লাখ পদ খালি আছে। তবু বড় কোনো সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন নেই। তাই চাকরিতে আবেদনও করতে পারছেন না চাকরিপ্রার্থীরা। সরকারি চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, এ নিয়ে তাঁদের হতাশাও বাড়ছে।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, করোনায় অনেক দিন চাকরির বাজারের স্থবিরতা হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বড় বা আকর্ষণীয় কোনো সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি না থাকায় এই হতাশা আরও বেড়ে গেছে। আগামী বছরে নির্বাচন ও চলমান মন্দায় নিয়োগ কমবে বলে আশঙ্কা করছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
চাকরিপ্রার্থীদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বেকার অবস্থায় তাঁরা এমনিতেই পরিবারে কোনো আর্থিক সহায়তা করতে পারছেন না। মুদ্রাস্ফীতির এই সময়ে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের পরিবারগুলোকে আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে। এই সময়ে সন্তানদের চাকরি হলে তাঁরা পরিবারের কাজে আসতে পারতেন। যেহেতু সরকার বড় নিয়োগদাতা, এ কারণে সরকারি খাতে নিয়োগ বাড়ানো উচিত বলে মনে করে চাকরিপ্রার্থীদের অভিভাবকেরা।
সরকারি চাকরির সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে শূন্য পদ কোথায় আছে, তা বের করার চেষ্টা করছি। সে অনুসারে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।’
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগে ৩ লাখ ৯২ হাজার ১১৭টি পদ শূন্য আছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। চলতি বছরের জুন মাসে জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ হোসেন এ তথ্য জানান। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপিত হয়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগে ৩ লাখ ৯২ হাজার ১১৭টি পদ শূন্য আছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য আলী আজমের প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিসিএসের মাধ্যমে ৪১ হাজার ৫৬৬ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এ সময়ে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে ৫ হাজার ১৪৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির (১০-১২তম গ্রেড) ৭ হাজার ১৬১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কর্ম কমিশন নবম ও তদূর্ধ্ব গ্রেড ৪ হাজার ৬৫৮ জন এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে ৪২ হাজার ৪০ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সাধারণত বড় নিয়োগ দেয় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সমন্বিত ব্যাংকগুলোতেও এক বছর ধরে বড় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। সাত শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন।
চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সাধারণত বড় নিয়োগ দেয় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সমন্বিত ব্যাংকগুলোতেও এক বছর ধরে বড় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই।
জানতে চাইলে জরিপের সমন্বয়ক ও বিআইডিএসের গবেষক মিনহাজ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে শিক্ষার গুণগত মান ভালো নয়। তাই সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এর সঙ্গে কলেজগুলোতে বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।
ব্যাংক–বিসিএসে নিয়োগ কমেছে
তরুণদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় চাকরি হলো বিসিএসের ক্যাডার ও নন–ক্যাডারের চাকরি। পিএসসি ক্যাডারের পাশাপাশি নন–ক্যাডার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও দেয়। কিন্তু গত এক বছরে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বলতে ৪৪তম বিসিএসের ২ হাজার ক্যাডার নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি। এর বাইরে নন–ক্যাডারে বড় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিএসসির একজন সদস্য বলেন, পিএসসি ৪০ থেকে ৪৪তম বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ইতিমধ্যে ৪০ ও ৪২তম বিসিএসের কাজ শেষ করেছে। অন্যগুলো দ্রুত শেষ করতে চায়। এই অবস্থায় নতুন একটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি আগামী ৩০ নভেম্বর প্রকাশ করবে। এ ছাড়া নন–ক্যাডারের কিছু নিয়োগ নিয়েও কাজ চলছে। বিজ্ঞপ্তি আগামী বছরে প্রকাশিত হতে পারে।
২০২০ সালভিত্তিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির এখনো পরীক্ষাই নেওয়া হয়নি। অথচ ২০২১ ও ২০২২ দুটি বছর চলে যাচ্ছে। নতুন বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আবার কবে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক? আমাদের চাকরির বয়স তো চলে যাচ্ছে।চাকরিপ্রার্থী
বিসিএসের পর তরুণদের কাছে ব্যাংকের চাকরি বেশ জনপ্রিয়। আগে সরকারি ব্যাংকগুলো আলাদা আলাদাভাবে নিয়োগ দিত। সেখানে একই প্রার্থী বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করতেন। তরুণদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সব ব্যাংকে নিয়োগ সহজ করতে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যভুক্ত আটটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ক্যাশ অফিসার, সাধারণ অফিসার, সিনিয়র অফিসার (আইটি) ও অফিসার রুরাল ক্রেডিট (আরসি) পদে ৫ হাজার ৮৬ জন নিয়োগের জন্য সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। এটি ছিল ২০২০ সাল ভিত্তিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এসব পদে নিয়োগের জন্য এখনো কোনো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। এ ছাড়া নতুন বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়নি। এ নিয়েও হতাশায় ভুগছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, ২০২০ সালভিত্তিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির এখনো পরীক্ষাই নেওয়া হয়নি। অথচ ২০২১ ও ২০২২ দুটি বছর চলে যাচ্ছে। নতুন বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আবার কবে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক? আমাদের চাকরির বয়স তো চলে যাচ্ছে।
রেলের নিয়োগের গতি কম
রেল মন্ত্রণালয় সরকারের অন্যতম বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। গত জুনে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, রেলওয়ের শূন্য পদের সংখ্যা ২২ হাজার ৭০৪। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ২০১টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ১ হাজার ৬০১টি, তৃতীয় শ্রেণির ৮ হাজার ৫৭৫টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১২ হাজার ৩২৭টি। কিন্তু এর মধ্যে শুধু তিনটি পদে ২ হাজার ৪০৮ জন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে রয়েছে সহকারী স্টেশনমাস্টার পদে ৫৬০ জন, পয়েন্টসম্যান পদে ৭৬২ জন ও খালাসি পদে ১ হাজার ৮৬ জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। সহকারী স্টেশনমাস্টার ও পয়েন্টসম্যান পদের জন্য পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কিছু পদের জন্য পিএসসিতে চাহিদা পাঠানো হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বাকি পদগুলোতে নিয়োগের এখনো কোনো খোঁজ নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ২০১৬ সালে বড় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। সেই নিয়োগই এখনো শেষ করতে পারেনি। ইউনিয়ন সমাজকর্মী পদে জনবল নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল সমাজসেবা অধিদপ্তর। এতে ৬৬৩ পদের বিপরীতে আবেদন করেছিল ৬ লাখ ৬২ হাজারের বেশি প্রার্থী। গত মাসে এই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়।
বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নেই
বিসিএস ও ব্যাংকের বাইরে বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), খাদ্য অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। কিন্তু গত এক বছরে দুদক সহকারী পরিচালকের কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ২০১৬ সালে বড় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। সেই নিয়োগই এখনো শেষ করতে পারেনি। ইউনিয়ন সমাজকর্মী পদে জনবল নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল সমাজসেবা অধিদপ্তর। এতে ৬৬৩ পদের বিপরীতে আবেদন করেছিল ৬ লাখ ৬২ হাজারের বেশি প্রার্থী। গত মাসে এই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়।
অধিদপ্তরের একজন উচ্চ পদের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ নিয়োগ শেষ না করে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির দিকে যাবে না অধিদপ্তর। সে জন্য সামনে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আশা কম।
রেলওয়ের শূন্য পদের সংখ্যা ২২ হাজার ৭০৪। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ২০১টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ১ হাজার ৬০১টি, তৃতীয় শ্রেণির ৮ হাজার ৫৭৫টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১২ হাজার ৩২৭টি। কিন্তু এর মধ্যে শুধু তিনটি পদে ২ হাজার ৪০৮ জন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ থেকে পাস করেছেন কামরুল হাসান। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন পাশ করে বেড়িয়েছি তখন করোনা শুরু হয়ছে। এই সময়ে নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি বন্ধ হয়ে যায়। আবার গত দেড় বছরে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। সব মিলে আমাদের তিন বছর মাটি। পাস করার পর আমরা সাধারণত চার থেকে পাঁচ বছর চাকরির বয়স পাই। সেখান থেকে তিন বছর গেলে আর কী থাকে! সব মিলে হতাশায় আছি। এখন বলা হচ্ছে, সরকার খরচ কমাতে নতুন নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। আসলে আমরা যাব কই? আমাদের কথা কি সরকার ভাবে?’
প্রথম শ্রেণির পদের বিজ্ঞপ্তি কমেছে
গত বছর ও এ বছরের ৫০টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রথম শ্রেণির বড় নিয়োগ একেবারেই কমে গেছে। যেসব পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদ। এসব পদের মধ্যে রয়েছে—কম্পিউটার অপারেটর, ড্রাফটসম্যান, অফিস সহায়ক, উচ্চমান সহকারী এসব পদের বিজ্ঞপ্তি দেখা গেছে।
যখন পাশ করে বেড়িয়েছি তখন করোনা শুরু হয়েছে। এই সময়ে নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি বন্ধ হয়ে যায়। আবার গত দেড় বছরে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। সব মিলে আমাদের তিন বছর মাটি। পাস করার পর আমরা সাধারণত চার থেকে পাঁচ বছর চাকরির বয়স পাই। সেখান থেকে তিন বছর গেলে আর কী থাকে! সব মিলে হতাশায় আছি। এখন বলা হচ্ছে, সরকার খরচ কমাতে নতুন নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। আসলে আমরা যাব কই? আমাদের কথা কি সরকার ভাবে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আরেক তরুণ সালেহীন কবির বলেন, ‘প্রথম শ্রেণির পদের চাকরি আমাদের পছন্দ হলেও আবেদন করার পদ পাচ্ছি না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদের বিজ্ঞপ্তি আছে তাও পরিমাণে কম। সরকার বলেছিল, চার লাখ পদ খালি। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি তো সেভাবে দেখি না। আমাদের হতাশা দিন দিন বেড়েই চলছে।’