১৬০ কোটি শিশু বঞ্চিত হবে ১০ লাখ কোটি ডলার উপার্জন থেকে
রাজধানীর বাসিন্দা সাড়ে চার বছরের রূপকথা দত্ত কোভিড-১৯-এর প্রকোপের মধ্যেই শিক্ষাজীবন শুরু করেছে। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস দিয়ে, অভিজ্ঞতা হিসেবে এটি অনন্য হয়ে থাকবে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষণের পরিবেশ সেভাবে পাওয়া না গেলেও শেখার প্রেরণা কিছুটা হলেও পাচ্ছে সে।
অন্যদিকে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা এখন হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। এমনকি যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তারাও এখন পড়াশোনার বাইরে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলার শিশুদের পক্ষে তো আর অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব নয়।
অনলাইনে ক্লাস করতে প্রথমেই প্রয়োজন ডিজিটাল যন্ত্র—স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ বা ট্যাব। এরপর দরকার ইন্টারনেট সংযোগ। কিন্তু এই দুটিতেই বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। সেই সঙ্গে আছে গ্রাম-শহরের ব্যাপক ব্যবধান।
কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এক বক্তৃতায় বলেছেন, কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ১৬০ কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। এতে এই শিশুরা জীবদ্দশায় ১০ লাখ কোটি ডলারের উপার্জন থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাস্তবতা হলো, একটি শ্রেণির শিশু যেখানে শিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে আরেকটি শ্রেণির শিশু সেই সুযোগ পাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই যারা সুযোগ পাচ্ছে না, তারা আরও পিছিয়ে পড়বে। এমনিতেই দেশে গ্রাম-শহরের ব্যবধান বেশি। মহামারির প্রভাবে সেই ব্যবধান আরও বাড়ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ১৮ দশমিক ২ শতাংশ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। চীনে সেই হার ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ, ভারতে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২১।
অর্থনীতির নানা সূচকে বাংলাদেশ ভালো করলেও ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে পারিবারিক পর্যায়ে কম্পিউটার ব্যবহারের হার খুবই কম—১০ শতাংশের নিচে। ভারতে যেটা ২০ শতাংশের কাছাকাছি এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭০ শতাংশের ওপরে। আবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলায় যেখানে কম্পিউটার ব্যবহার করছে ৪০ শতাংশের বেশি পরিবার, সেখানে রংপুর অঞ্চলে তা ২০ শতাংশের কম।
অন্যদিকে ইন্টারনেটের বিস্তারের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ১৮ দশমিক ২ শতাংশ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। চীনে সেই হার ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ, ভারতে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২১।
এই বাস্তবতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম চলছে সংসদ টেলিভিশনে। বড় শহরে অনলাইনে ক্লাস হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংসদ টেলিভিশনই ভরসা। তবে কিছু কিছু জায়গায় ছোট পরিসরে কোচিং চলছে বলে জানা গেছে। বাস্তবতা হলো, বড় শহরের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে অনলাইনে ক্লাসের বিষয়ে কিছুটা আগ্রহ থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ব্যবস্থা করাই সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি চিলমারীর প্রাথমিক শিক্ষক নাহিদ হাসান বলেন, বড় শহরের মতো এখানে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা চিন্তা করাও অসম্ভব। ডিজিটাল অবকাঠামো ও বিদ্যুতের ঘাটতি তো আছেই, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দারিদ্র্য। কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিশুরা পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পরিবারের সক্রিয়তা ও তৎপরতার ওপর এখন শিশুদের শিক্ষণ নির্ভর করছে। আর শিক্ষকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন—শিক্ষা কার্যক্রম বলতে এটুকুই।
সানেম ও একশনএইডের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় সব শ্রেণি ও অঞ্চলের নারীরা ডিজিটাল যন্ত্র ও ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে আছেন। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র অঞ্চল ও পরিবারের নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে আছেন। দেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মূলত নারীরাই শিশুদের পড়াশোনা দেখাশোনা করেন। সে কারণে অনলাইনে শিশুদের পড়াশোনা করানোর ক্ষেত্রে নারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা বিশেষ প্রয়োজন। সক্ষমতার প্রশ্ন তো আছেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়েমা হক বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে শিক্ষা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শহরাঞ্চলের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে অনলাইন শিক্ষা উপকরণ ও কার্যক্রমের সুবিধা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নেই বললেই চলে—বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও সংশ্লিষ্ট উপকরণের স্বল্পতার কারণে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও। গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সেই সঙ্গে আছে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
সায়েমা হক আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে কোভিড-১৯-এর কারণে একধরনের আর্থিক এবং এলাকা ও নারী-পুরুষভিত্তিক ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান বৈষম্য আরও বাড়ছে। দ্রুত সমাধান না হলে ভবিষ্যতে মানবসম্পদ গঠন ও দক্ষতার ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হবে, যে কারণে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর জন্য গ্রামের পরিবারগুলোকে স্বল্প মেয়াদে আর্থিক সহায়তা করা দরকার। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে ভিন্ন ভিন্ন ধারার (বাংলা, ইংরেজি ও ধর্মীয়) শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আনা এবং এদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করেন তাঁরা। তৃণমূলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সহজলভ্য করার পাশাপাশি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন কেনায় ঋণ দেওয়া দরকার বলেও মনে করেন তাঁরা।