২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সত্যিকারের সংকট নাকি লুকানো তেল বাজারে আসবে

সয়াবিন তেল
ফাইল ছবি

ঈদ সামনে রেখে সপ্তাহখানেক ধরে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট চলছিল। ঈদের পরে সংকট আরও তীব্র হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের খুচরা বাজারের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জেও সয়াবিন তেলের তীব্র সংকটের চিত্র দেখেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। বাজারে এমন তীব্র সংকটের সময় নতুন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেন মিলমালিকেরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মিলমালিকেরা। আর খোলা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয় লিটারে ৪৪ টাকা। বাড়ানো হয়েছে পাম তেলের দামও।

বিশ্ববাজারে অস্থিরতার কারণে দুই মাস ধরে সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি কমে আসছিল। আবার ঈদের পর দাম বাড়ানো হবে—এমন ঘোষণায় বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের তীব্র সংকট তৈরি হয়। কারণ, দাম বাড়লে তাতে পুরোনো দামে কেনা সয়াবিন তেল বাড়তি দামে বিক্রি করা যাবে—এমন আশায় পরিবেশক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেকে তেল লুকিয়ে রেখেছিলেন। দাম বাড়ানোর কারণে লুকিয়ে রাখা এসব তেল বাজারে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আমদানির ঋণপত্র খোলার হার না বাড়ালে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে দেশে ভোজ্যতেলের শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারক টি কে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভোজ্যতেলের সংকট কাটাতে এখন একমাত্র উপায় আমদানি বাড়ানো। সেই সঙ্গে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট সব মহলের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

ঘরে ও বাজারে তীব্র সংকট

ঈদের আগে থেকে কয়েক দিন ধরেই রাজধানীর অলিগলির দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বাজারগুলোতে অল্পবিস্তর কিছু তেল পাওয়া যাচ্ছে। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে কোনো ধরনের বোতলজাত তেল নেই। এতে অনেকেই বিপাকে পড়ছেন। বাধ্য হয়ে অনেকে পাম তেল বা সূর্যমুখী তেল কিনছেন।

রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা ও কল্যাণপুরের কয়েকটি অলিগলি ঘুরে অন্তত ১২টি দোকানে গতকাল বোতলজাত তেল পাওয়া যায়নি। দোকানিরা বলছেন, বেশির ভাগ মুদিদোকানে সয়াবিন তেল নেই। কোম্পানির পরিবেশকেরা তাঁদের তেল দিচ্ছেন না। রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগের মা জেনারেল স্টোরের দোকানি মো. নজরুল বলেন, ‘আমার দোকানে ঈদের আগে থেকে কোনো তেল নেই।’

পাড়া-মহল্লায় তেলসংকটের একই কথা জানালেন মালিবাগ সি ব্লকের মুদিদোকানি মো. সবুজ, চৌধুরীপাড়ার দোকানি মো. তৈয়ব, রামপুরা বাজার এলাকার দোকানি রাজীব হোসেন। তাঁরা বলছেন, বাজারে তেলের সংকট চলছে ঈদের আগে থেকেই।
কল্যাণপুর গার্লস স্কুল এলাকার বাসিন্দা সামিউল বাশার গতকাল দুপুরে তেল কিনতে বের হন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেহমান আসবে বাসায়। কিন্তু ঘরে তেলের স্বল্পতা। জরুরি দুই লিটার তেল দরকার। কিন্তু মহল্লার সাতটা দোকান ঘুরে একটিতেও তেল পেলাম না।’

এদিকে গতকাল বিকেলে তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার পর সন্ধ্যায় রাজধানীর দুটি বাজার ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার মার্কেটের ২০টি দোকান ঘুরে কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। তবে এই বাজারে সূর্যমুখী, শর্ষে ও রাইস ব্র্যান তেল আছে।

একই অবস্থা চট্টগ্রামেও। নগরীর হালিশহরের সন্দ্বীপ স্টোরে এক সপ্তাহ ধরে সয়াবিন ও পাম তেলের তাক খালি। দোকানের মালিক আমিনুর রসুল প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ১০ দিন আগে থেকে কোম্পানির পরিবেশকেরা কোনো তেল সরবরাহ করেননি। যেটুকু সংগ্রহে ছিল, তা ঈদের তিন দিন আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাই এখন বিক্রির জন্য দোকানে কোনো তেল নেই।

চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট এলাকার কর্ণফুলী কমপ্লেক্সের জালাল স্টোরের মালিক আবদুল্লাহ আল নোমানও জানালেন একই কথা, তেল নেই।

এদিকে বাজারে তীব্র সংকটের কারণে তেল না পাওয়ায় অনেকের ঘরে কাটছাঁট হয়েছে ঈদের রান্না। তাঁদেরই একজন রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন। ঈদের আগের দিন রোস্ট রান্না করতে গিয়ে দেখেন, ঘরে তেল নেই। বাধ্য হয়ে একই ভবনের প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করলেন সামান্য কিছু তেল। প্রতিবেশীর ঘরেও ছিল তেলের স্বল্পতা। সামান্য যেটুকু তেল ছিল, তা ভাগাভাগি করতে গিয়ে হাত ফসকে কিছু তেল ফ্লোরে পড়ে যায়। তাতেই শাহনাজ পারভীন ও তাঁর প্রতিবেশীর হাহাকার। শেষে তেলসংকটে রোস্ট রান্না বাদ দেন শাহনাজ পারভীন।

এক লাফে দাম বাড়ল ৩৮-৪৪ টাকা

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশেও মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে গতকাল বাণিজ্যসচিবের সঙ্গে মিলমালিকেরা বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এক বিজ্ঞপ্তিতে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকায়, যার বর্তমান দাম ১৬০ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা, যেটি বর্তমানে ৭৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রি হবে।

বর্তমানে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা ও পাম তেল ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও অপরিশোধিত পাম তেলের দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে। বিশ্ববাজারে সাম্প্রতিক সময়ে তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণে দেশেও মূল্য সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

রোজার আগে ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে দুই দফা মূল্য সংযোজন কর কমিয়েছে সরকার। এরপর গত ২০ মার্চ সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে। আর খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা কমিয়ে ১৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। দেশের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বাজারে একসঙ্গে এত মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা আগে ঘটেনি। তাঁদের দাবি, বিশ্ববাজারেও এভাবে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেনি।

আমদানি কম

দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে পূরণ করা হয়। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি করে এবং বীজ আমদানি করে তা ভাঙিয়ে তেল উৎপাদন করে আটটির মতো প্রতিষ্ঠান।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত মার্চ ও এপ্রিল—এই দুই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে ১ লাখ ৪১ হাজার টন সয়াবিন তেল কাস্টম বন্ডেড ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস করেছে কোম্পানিগুলো। ট্যাংক টার্মিনালে পুরোনো তেল মজুত ছিল, সেগুলোও খালাস করেছে কোম্পানিগুলো।

আমদানি কমেছে পাম তেলেরও। গত মার্চ ও এপ্রিল—দুই মাসে পাম তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার টন। একই সময়ে বাজারজাত হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয় ২ লাখ ৬৭ হাজার টন। আর বাজারজাত হয় ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। সব হিসাবে আগের তুলনায় আমদানি ও বাজারজাত দুটোই কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। আজ দাম বাড়ছে তো কাল কমছে। আবার বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে দেশের বাজারের দামের সমন্বয় নেই। এই দুই কারণে আমদানিকারকেরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। আবার ইন্দোনেশিয়া গত মাস থেকে পাম তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আর্জেন্টিনাও রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় ভোজ্যতেল আমদানির জন্য উৎস দেশও সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে দাম বাড়ানোর পরও আমদানি কতটা বাড়বে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।

বিশ্ববাজারে অস্থিরতার কারণ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভোজ্যতেলের বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা এখনো থামেনি। মাঝে বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা সংশোধন হলেও তা বেশি দিন থাকেনি। মার্চের মাঝামাঝি আর্জেন্টিনা সয়াবিন তেল রপ্তানি সীমিত ও গত মাসে ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করায় বিশ্ববাজারে দামের অস্থিরতা আরও বেড়েছে। ২৮ এপ্রিল থেকে ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য লেনদেনের বাজার বা কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে এক দিনেই সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে টনপ্রতি ১৬১ ডলার বা লিটারে ১৩ টাকা। যদিও পরদিনই আবার এ দাম লিটারে ১৪ টাকা কমে যায়। তবে গত বুধবার লিটারে দাম আবারও সাড়ে ৭ টাকা বেড়েছে। দামের উত্থান-পতনের একই অবস্থা পাম তেলের ক্ষেত্রেও।

সংকট ও মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিলিয়ে যেহেতু মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে, তাতে এখন ভোজ্যতেলের সংকট হওয়ার কথা নয়। এরপরও কেউ যাতে সংকট তৈরি করতে না পারে, সে জন্য আগের মতো তদারক করা দরকার, যাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।