সঞ্চয়পত্রের মুনাফা জমা হচ্ছে না গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে
করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে সীমিত আকারে খোলা রয়েছে ব্যাংক। এ সময়ে মেয়াদপূর্তি হওয়া সঞ্চয়পত্র নগদায়ন ও মাসিক মুনাফার অর্থ গ্রাহকেরা তুলতে পারবেন বলে ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকেরা ব্যাংকে গিয়েও ফিরে আসছেন। কারণ, তাদের হিসাবে কোনো মুনাফা জমা হচ্ছে না।
জানা গেছে, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর গ্রাহকদের হিসাবে মুনাফার টাকা পাঠাচ্ছে না। এ কারণে পেনশনধারী, স্বল্প আয়ের নারী গ্রাহক থেকে শুরু করে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকই এখন বিপদে পড়েছেন। মুনাফা তুলতে ব্যাংকে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর এবং একাধিক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে এ পরিস্থিতির কথা জানা গেছে।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রতি মাসের শুরুতেই ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে আগের মাসের মুনাফার টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হয়ে আসছে। তাই এখন আর কাউকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাবাবদ নগদ টাকা দেওয়া হয় না। কিন্তু এ মাসে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা জমা হয়নি।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯–২০ অথর্বছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকেরা মুনাফা পেয়েছেন ১৮ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। গত জানুয়ারিতে বিতরণ করা মুনাফার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। সাত মাসের গড় হিসাবে প্রতি মাসে ২ হাজার ৬১১ কোটি টাকা করে মুনাফা দিতে হয়েছে গ্রাহকদের।
মোটা দাগে চার ধরনের সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকই দেশে বেশি। এগুলো হচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা, সঞ্চয় ব্যুরো, ডাকঘর এবং নির্ধারিত বাণিজ্যিক ব্যাংক (লিঙ্কড ব্যাংক) থেকে গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন।
তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক বরিশালের নাসিমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, 'মুনাফার টাকা তোলার জন্য প্রতি মাসের ২ থেকে ৩ তারিখের দিকে ব্যাংক থেকে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাই। এবার এখনো পাইনি। ব্যাংকে গিয়ে সরাসরি জানতে চাইলেও সঠিক কোনো জবাব মেলেনি।'
সরকারি চাকরি থেকে দুই বছর আগে অবসরে যাওয়া সালেহা বেগম পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন ঢাকার একটি ব্যাংক থেকে। একই বিপদে আছেন তিনিও। মোবাইল ফোনে সালেহা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, 'আমি বাড়িভাড়া দিই এবং মাসের খরচ চালাই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়ে। কিন্তু ব্যাংকে এবার মুনাফা জমা হয়নি দেখে তো আমার মাথায় হাত। আমরা তো আর মানুষের কাছে হাত পাততে পারব না। চলব কীভাবে?'
নাসিমুল আলম ও সালেহা বেগমের মতো অনেকেই এ রকম বিপদে রয়েছেন বলে মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। মুনাফার টাকা তাহলে আছে কোথায়? ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে না কেন? ব্যাংক তো খোলা! এটা কি ব্যাংক খাতের কোনো সমস্যা নাকি এই সময়ে নিজের প্রয়োজনে টাকা ধরে রেখেছে সরকার?
এ সব প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সঞ্চয় অধিদপ্তরের ১ থেকে ২ জন লোকের কয়েক মিনিটের কাজ এটি। অফিসে গিয়ে কম্পিউটারে কয়েকটা চাপ দিয়েই তারা টাকাটা ছাড় করতে পারেন। কেন তারা তা করছেন না, সেটিই রহস্যজনক।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাসের পুরো টাকাই যে আটকে রয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে বা পরে বাংলাদেশ ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো থেকে যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, তারা টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু লিঙ্কড ব্যাংক থেকে কিনে থাকলে সঞ্চয় অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের মুনাফা দেয় না। এবার সেটাই হয়েছে। সরকারি ছুটির কারণে অধিদপ্তরের কর্মচারীরদের কেউ অফিসে না আসায় মুনাফা পাচ্ছেন না অসংখ্য গ্রাহক।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সামছুন্নাহার বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গত চার দিনে তাকে অন্তত ১০ বার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করা হয়। একবারও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাাঠানো হলেও তারও কোনো জবাব দেননি।
তবে অধিদপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক রাজিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, 'এখন তো ছুটি। ছুটি শেষ হলে এ বিষয়ে বলা যাবে।'
গ্রাহেকর ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আশা করছি, শিগগির সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মচারীরা অফিসে গিয়ে কম্পিউটারে কয়েকটা ক্লিক করবেন, গ্রাহকেরাও তখন মুনাফার টাকা পেয়ে যাবেন।