গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় হঠাৎ ঝোড়ো বৃষ্টি শুরু হয়। কিন্তু তীব্র দাবদাহে অস্থির নগরবাসীর জন্য স্বস্তির এই বৃষ্টি ফুটপাতের পানি বিক্রেতা মো. ওয়াসিমের কাছে ছিল দুশ্চিন্তার। কারণ, বৃষ্টিতে তাঁর পানি বিক্রি কমেছে। ওয়াসিম জানান, সম্প্রতি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এমনিতেই দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে তাঁর; এর মধ্যে বৃষ্টি ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে। অর্থাভাবে নবম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেকে প্রয়োজনীয় বই কিনে না দিতে পারায় মানসিক কষ্টে ভুগছেন ভ্রাম্যমাণ এ পানি বিক্রেতা।
ফার্মগেটসংলগ্ন তেজগাঁও মহিলা কলেজের গলির সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াসিমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওয়াসিম জানান, এত দিন মাসে যা আয় হতো, তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার খরচ চালিয়ে নিতেন। কিন্তু এখন সেটি পারছেন না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সংসার খরচে টান পড়েছে। তাতে অনেক খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। উল্টো মাঝেমধ্যে ধারদেনা করতে হচ্ছে।
ঢাকার সায়েদাবাদের একটি আবাসিক হোটেলে থাকেন ওয়াসিম। আর তিন ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী থাকেন পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙা ইউনিয়নের সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে পাওয়া ঘরে। ওয়াসিম জানান, দৈনিক ৭ থেকে ৮ কেস (১ কেসে ১২ বোতল) পানি বিক্রি করে গড়ে ৭০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এ টাকায় নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে পরিবারের জন্য মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা পাঠাতে পারেন তিনি। কিন্তু এ টাকায় সংসার চালানো, ঋণ পরিশোধ ও দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ফুটপাতের এই হকার জানান, সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিন সকালে বাসে মালিবাগ রেলগেট আসেন। পরে সেখান থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত হেঁটে আসেন। সন্ধ্যার দিকে আবার একইভাবে সায়েদাবাদ ফিরে যান। ওয়াসিম আরও বলেন, ‘ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার এলাকায় বেশি যানজট থাকে। তাই ভালো বিক্রির আশায় এ এলাকায় আসি।’
আলাপকালে ওয়াসিম জানান, দিনে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সারেন তিনি। সকাল ও দুপুরবেলা কাটে কলা, বিস্কুট ও চা খেয়ে। সেই খরচও এখন বেড়ে গেছে। রাতে হোটেলে ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে সবজি, ডিম বা কম দামি কোনো মাছের তরকারি দিয়ে খান। কখনো কখনো দুপুরে ভাত খান। যেদিন দুপুরে ভাত খান, সেদিন আর রাতে ভাত খান না। ঢাকায় থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত মিলিয়ে মাসে প্রায় আট হাজার টাকা খরচ হয় তাঁর। এ ছাড়া মাসে ওষুধ খরচ বাবদ প্রায় ৫০০ টাকা লাগে নিম্ন আয়ের এ মানুষের।
ওয়াসিমের বড় ছেলে মো. লাবিব বিজ্ঞান বিভাগে নবম শ্রেণিতে আর মেজ ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট ছেলের বয়স দুই বছর। ছেলেদের পড়ালেখা, যাতায়াত ও টিফিন খরচ মিলিয়ে মাসে লাগে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হয়। বাকি টাকায় সংসারের যাবতীয় খরচ সামলান তাঁর স্ত্রী।
সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সংসারের খরচ কাটছাঁট করতে হয়েছে বলে জানান ওয়াসিম। তিনি বলেন, বাড়িতে রান্নায় তেলের ব্যবহার কমিয়েছেন স্ত্রী। আগে মাঝেমধ্যে বাসায় রুটি বানানো হতো, এখন সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলেকে আগে স্কুলে যাওয়ার সময় নাশতা খরচের জন্য সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হতো। এখন তা নিয়মিত দিতে পারছেন না। মাছ, গরুর মাংস বা ভালো কোনো তরকারি রান্নার চিন্তা বাদ দিয়েছেন।
ওয়াসিম বলেন, ‘নানাভাবে খরচ কমিয়েও আমার স্ত্রী খুব কষ্ট করে সংসারটা ধরে রেখেছে। আমরা চাই যেকোনোভাবেই হোক ছেলেদের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে। কিন্তু সেটা কতটা পারব, তা জানি না। সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা। বেশ কিছু বইপত্র কিনে দেওয়া দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে কিনে দিতে পারছি না।’