২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

লাসভেগাসসহ বড় বড় শহরে সিকদার পরিবারের বিপুল সম্পদ

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে কার্যক্রম শুরু করে কয়ি রিসোর্ট অ্যান্ড রেসিডেন্স। যেটি পরিচালনা করছে বিশ্বখ্যাত হিলটন কর্তৃপক্ষ। বিনিয়োগের বিপরীতে নাগরিকত্ব সুবিধার আওতায় ৫৩ হাজার জনসংখ্যার দেশটিতে এ চার তারকা হোটেল গড়ে তোলা হয়েছে। এই কয়ি রিসোর্টের কর্ণধার বাংলাদেশের সিকদার পরিবার।

কয়ি রিসোর্টের নিজস্ব প্রকাশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার এবং যুক্তরাষ্ট্রের কয়ি গ্রুপ ও কেআরএল হসপিটালিটির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান নিক হক এ রিসোর্টের নির্মাতা। তাঁরা সম্পর্কে পিতা-পুত্র।

সিকদার পরিবারের মালিকানাধীন কয়ি রেস্টুরেন্ট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্ক, প্রমোদ নগরী হিসেবে খ্যাত লাসভেগাস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি ও থাইল্যান্ডের ব্যাংককেও। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে রয়েছে সিকদার পরিবারের একাধিক কোম্পানি ও বিপুল বিনিয়োগ। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলও রয়েছে।

এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও অতিরিক্ত এমডিকে গুলি এবং আটক করে নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত সিকদার পরিবারের নামে সম্পদ শুধু এসব দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীর আরও বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে কোথায় নেই সিকদার পরিবারের সম্পদ, এমন প্রশ্নও উঠছে। তবে অনেক দেশ বিনিয়োগ তথ্য প্রকাশ না করায় বিদেশে তাদের কত সম্পদ রয়েছে, তা জানা যায়নি। আর সব দেশের তথ্য জানাও সম্ভব হয়নি। ওই ঘটনার পর রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে থাইল্যান্ডে পাড়ি দেন।

এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটে গত ৭ মে। ঘটনা চাপা দেওয়ার নানা ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে এক্সিম ব্যাংকের পক্ষে গুলশান থানায় মামলা করা হয় গত ১৯ মে। আর গত ২৫ মে মূল আসামি রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার রোগী সেজে দেশ ত্যাগ করেন। সিকদার গ্রুপ ক্ষমতাসীন সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করা হয়েছে সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে পারভীন হক সিকদারকে। দেশের বাইরে তাঁর নামেও ব্যবসা রয়েছে।

>

বিভিন্ন দেশে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে আলোচিত সিকদার গ্রুপের। কিন্তু এর উৎস অজানা।
প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগ

জানা গেছে, দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন মামলা না হওয়ার জন্য। এমনকি মামলা হওয়ার পরে ব্যবস্থা না নিতেও পুলিশের কাছে তদবির করা হয়। তবে সরকারের ওপর মহল থেকে নির্দেশ আসাতেই শেষ পর্যন্ত মামলা হয় বলে সূত্রগুলো জানায়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামলার তদন্ত চলছে। ঘটনার দিন ব্যবহার করা গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এখন ব্যবহার করা পিস্তলটি খোঁজা হচ্ছে। আর মামলার অগ্রগতি জানতে আজ মঙ্গলবার পুলিশের সদর দপ্তরে একটি সভা ডাকা হয়েছে।

এদিকে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিকদার গ্রুপের এসব সম্পদ বাড়তে শুরু করে এক দশক ধরে। আর তাদের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক খারাপ হতে শুরু করে ওই সময় থেকে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কোনো অর্থ বিদেশে নেয়নি পরিবারটির কোনো সদস্য। ফলে বিদেশে এসব সম্পদের উৎস নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে বিদেশে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য একজন রপ্তানিকারক ব্যবসা বাড়াতে অন্য দেশে লিয়াজোঁ বা সাবসিডিয়ারি অফিস খোলা ও ব্যয় নির্বাহের জন্য বছরে ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত নিতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। রপ্তানির একটি অংশ বা এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসাব থেকে এসব বিনিয়োগ করা হয়। তবে এর মধ্যে সিকদার গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।

 জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করেছে, তাদের মধ্যে সিকদার গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমোদন ছাড়া কেউ দেশের বাইরে টাকা নিলে অর্থ পাচার আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ইদানীং লাখ কোটি টাকা পাচারের খবর আসছে। এটার প্রধান মাধ্যম আমদানি-রপ্তানি। একটা সমাজে অপরাধ হবেই, তবে কিছু লোক আইনের ঊর্ধ্বে গেলে তা সাংঘাতিক বেড়ে যায়। তখন তারা যা ইচ্ছা তা–ই করতে পারে। এটার প্রমাণ দেখা গেল কথিত ক্যাসিনো অভিযানে। যত দিন যাচ্ছে, সমাজে আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া কিছু লোক যে আছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই মাত্রায় অপরাধমূলক কাজ সম্ভব নয়।

 বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়ও সিকদার পরিবারের সম্পদ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। ব্যাংক, বিমা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, নির্মাণ, হোটেল, পর্যটন, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন খাতে গ্রুপটির ব্যবসা রয়েছে। পরিবারটির সবচেয়ে বড় ব্যবসা এখন বিদ্যুৎ খাতের পাওয়ার প্যাক হোল্ডিং। পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংয়ে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে সিকদার গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে। কোথায় কী ব্যবসা—এ নিয়ে সেখানে কিছু লেখা নেই। এর সূত্র ধরে বিভিন্ন দেশের কোম্পানি নিবন্ধন কার্যালয়ে খোঁজ নিয়েই বিদেশে বিপুল বিনিয়োগের এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 বাংলাদেশের আর্থিক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে সিকদার গ্রুপের ব্যবসা বিকশিত হওয়া শুরু হয় ২০০৯ সালের পর। নতুন নতুন একাধিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তাদের দেওয়া হয়। আর ন্যাশনাল ব্যাংক পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর বিদেশেও সম্পদ বাড়তে শুরু করে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাইরে এত সম্পদ হলো কীভাবে? নিশ্চয়ই এত বৈধ সম্পদ দেশের বাইরে নিয়ে যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার প্রয়োজন মনে করলে বিদেশে তাদের এত সম্পদের উৎস জানতে খোঁজ করতে পারে। তবে নেবে বলে মনে হয় না।

 খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, তারা কত ক্ষমতাবান, একটি ঘটনা থেকেই তা বোঝা যায়। আতিউর রহমান গভর্নর থাকাকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে তাদের পরিবারের তিন পরিচালককে সরিয়ে দুজনকে রাখার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তারা কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। পরে আইন পরিবর্তন হয়ে গেছে, চারজন পরিচালক রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ওই পরিবারের এখনো পাঁচজনই পরিচালক।

এ নিয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও সিকদার গ্রুপের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

থাইল্যান্ডে ২০০৪ সালে রেস্তোরাঁ ব্যবসা খোলে সিকদার পরিবার। দেশটির কোম্পানি নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্য। ও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় পারভীন হক সিকদারের কোম্পানির  নিবন্ধনের দলিল
থাইল্যান্ডে ২০০৪ সালে রেস্তোরাঁ ব্যবসা খোলে সিকদার পরিবার। দেশটির কোম্পানি নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্য। ও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় পারভীন হক সিকদারের কোম্পানির নিবন্ধনের দলিল

থাইল্যান্ড পর্ব
২০১৮ সালের এপ্রিলে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বড় আয়োজন করে চালু হয় কয়ি রেস্টুরেন্ট স্যাথর্ন ও দ্য ক্লাব অ্যাট কয়ি। এটা মূলত কয়ি গ্রুপের বর্ধিত হোটেল ও বিনোদন ব্যবসা। এতে যোগ দেন বিভিন্ন দেশের তারকারা। নিক হক সিকদার, রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের সৌজন্যে এতে দেওয়া হয় রাজসিক ভোজ। ২০১৮ সালের ১২ মে সেই অনুষ্ঠানের ৩৬টি ছবিসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয় থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত লুকইস্ট নামের একটি ম্যাগাজিনে। সেখানে প্রথমেই বলা আছে, অনুষ্ঠানে কয়ি গ্রুপের রিক ও রন হক সিকদারের সৌজন্যে যত খুশি জাপানিজ খাবার, ককটেল এবং ওয়াইন সরবরাহ করা হয়।

 অবশ্য থাইল্যান্ডে এটাই তাদের প্রথম বিনিয়োগ নয়। ২০০৫ সালে ব্যাংককের সুকুম্ভিতে প্রথম কয়ি রেস্টুরেন্ট চালু করে তারা। এরপর দেশটির নানা শহরে চালু হয় এর শাখা। থাইল্যান্ডের ফুকেট ও পাতায়াতেও বিভিন্ন নামে হোটেল ও বিনোদন ব্যবসা রয়েছে তাদের।

থাইল্যান্ডের কোম্পানি নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট থাইল্যান্ডে কয়ি রেস্টুরেন্ট কোম্পানি নিবন্ধিত হয়। ওই সময়ে এর মূলধন ছিল ৬ কোটি বাথ, ওই সময়ে বাংলাদেশি টাকায় যা ছিল মাত্র ৯ কোটি টাকা। এর পরিচালক রিক হক সিকদার, রন হক সিকদার, সৈয়দ কামরুল ইসলাম ও জোনগ্রুক প্রুকপ্রেট।

এর মধ্যে সৈয়দ কামরুল ইসলাম (মোহন নামে পরিচিত) সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালক কর্মকর্তা এবং জোনগ্রুক প্রুকপ্রেট থাইল্যান্ডের নাগরিক। এই কোম্পানিতে পরিচালক চারজন হলেও শেয়ারধারী সাতজন। তাঁদের মধ্যে মার্কিন নাগরিক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদারের ৪৯ শতাংশ ও জোনগ্রুক প্রুকপ্রেটের ৫১ শতাংশ। আরও চারজন বাংলাদেশি পরিচালক থাকলেও শুরুতে কাগজে–কলমে তাঁদের কোনো বিনিয়োগ ছিল না। এরপর থাইল্যান্ডের একাধিক শহর ও পর্যটনকেন্দ্রে তারকা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, স্পা ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলে পরিবারটি।

থাইল্যান্ডে সিকদার গ্রুপের রয়েছে কার্লস জুনিয়র রেস্টুরেন্ট এবং হার্ডিস রেস্টুরেন্ট নামে আরও দুটি চেইন রেস্তোরাঁ। এ দুটি রেস্তোরাঁ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বার্গার খাবারের জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের ৪৩টি দেশে তাদের ৩ হাজার ৮০০ রেস্তোরাঁ (ফ্র্যাঞ্চাইজি) রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি আছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে, যা পরিচালনা করে আরঅ্যান্ডআর রেস্টুরেন্ট গ্রুপ। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ব্যাংকক পোস্ট গত ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর এ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই আরঅ্যান্ডআর গ্রুপের দুই মালিক রিক ও রন হক সিকদার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশেও তাঁদের আরঅ্যান্ডআর এভিয়েশন নামে একটি কোম্পানি আছে, যার উড়োজাহাজে করেই রোগী সেজে রন ও দিপু হক সিকদার দেশে ছেড়ে ব্যাংককে চলে যান। দেশে তাঁদের এই কোম্পানির সাতটি হেলিকপ্টার ও দুটি উড়োজাহাজ রয়েছে।

২০১৩ সালে সেন্ট কিটস ও নেভিসের প্রধানমন্ত্রী ডেনজিল ডগলাস নির্মাণাধীন কয়ি রিসোর্ট পরিদর্শন করেন, সঙ্গে নিক হক। ও কর্মীদের যথাযথ পারিশ্রমিক না দেওয়ায় ২০১০ সালে সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে ৬৬ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ মামলা হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
২০১৩ সালে সেন্ট কিটস ও নেভিসের প্রধানমন্ত্রী ডেনজিল ডগলাস নির্মাণাধীন কয়ি রিসোর্ট পরিদর্শন করেন, সঙ্গে নিক হক। ও কর্মীদের যথাযথ পারিশ্রমিক না দেওয়ায় ২০১০ সালে সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে ৬৬ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ মামলা হয় যুক্তরাষ্ট্রে।

যুক্তরাষ্ট্র পর্ব
এ তো গেল থাইল্যান্ড পর্ব। এরপর যাওয়া যাক যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের চ্যান্ডলার শহরে ২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরু করে অড়োয়া ভিলাস অ্যাপার্টমেন্ট এলএলসি। ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই কোম্পানি নিবন্ধিত হয়। কোম্পানি নম্বর হচ্ছে এল২১২১৫৬১৭। ওই শহরে ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যবসা করে এই প্রতিষ্ঠান। এর মালিক পারভীন হক সিকদার, তিনি জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে ও আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত আসনের সাংসদ। নিবন্ধনের সময় তাঁর ঠিকানা দেওয়া আছে, ৬০১৫ ডব্লিউ ট্রোভিটা প্লেস, চ্যান্ডলার, অ্যারিজোনা ৮৫২২৬।

আবার ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৮টি স্বয়ংক্রিয় কার ওয়াশ ও একাধিক সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনও রয়েছে তাদের। ২০১০ সালে শ্রমিকদের সঠিক বেতন ও ওভারটাইম না দেওয়ায় ৬৬ লাখ ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করেন এই আট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। পরে আদালতের মাধ্যমে তার কিছু অংশ পরিশোধের খবর দেশটির কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মামলায় সিকদার গ্রুপ ইনকরপোরেট, জেড এম এস গ্রুপ ইনকরপোরেট ও সিকদার হোল্ডিং ইনকরপোরেটকে আসামি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের মালিকানা সিকদারের আরেক পুত্র দিপু হক সিকদারের হাতে। লস অ্যাঞ্জলেস টাইমসে ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর সিকদার পরিবারের নামসহ এই সংবাদ ছাপা হয়।

আমেরিকার ট্রাম্প টাওয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কয়ি রেস্টুরেন্টের শাখা। নথিপত্রে কয়ি গ্রুপের চেয়ারম্যান নিক হক। কেআরএল হসপিটালিটিসহ দেশটিতে তাঁদের আরও অনেক ব্যবসা আছে। দেশটিতে তাঁদের আবাসন ব্যবসাও রয়েছে।

লন্ডন, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ড পর্ব
এবার ঘুরে আসা যাক লন্ডন থেকে। যুক্তরাজ্যের কোম্পানিজ হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে লন্ডনে সিকদার গ্রুপ নিবন্ধিত হয়। এর পরিচালক রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার। তাঁদের দুজনেরই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া আছে। আর তাঁদের ঠিকানা দেওয়া আছে থাইল্যান্ডের সুকুম্ভিতে।

এবার দেখে আসি সিঙ্গাপুরে ব্যবসা নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্য। ওই কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন ইন্টার এশিয়া গ্রুপ পিটিই। এর অধীনেই থাইল্যান্ডের পাতায়ায় রয়েছে ১৪টি বিশেষ ধরনের স্বতন্ত্র ভিলা ও জমিতেন সমুদ্রসৈকতে তৈরি বাড়ি (সি ব্রিজ রেসিডেন্স)। এ ছাড়া সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের কয়ি রিসোর্টও ইন্টার এশিয়া গ্রুপের অধীনে। ইন্টার এশিয়ার কার্যালয় রয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে।

সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের হোটেল এবং রিসোর্ট নির্মাণ ও কার্যক্রম শুরু নিয়ে একাধিক রিপোর্ট ছাপা হয়েছে সে দেশের স্থানীয় পত্রিকায়। এর মধ্যে সাউথ ফ্লোরিডা ক্যারিবিয়ান নিউজে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনে কয়ি হসপিটালিটি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিক হক ‍সিকদারের বক্তব্য রয়েছে। এই হোটেল নির্মাণ তাঁর স্বপ্নপূরণ—এ কথা উল্লেখ করে তাঁদের কার্যক্রম লস অ্যাঞ্জেলেস, লাস ভেগাস, নিউইয়র্ক, ব্যাংকক ও আবুধাবিতে আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। আবার এসকেএন নিউজে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হোটেলের জায়গা পরিদর্শন করছেন সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড. ডেনজিল এল ডগলাস ও হক সিকদার।

আর সুইজারল্যান্ডে খোঁজ নিয়ে মিলল যে কেবল হোটেল বা আবাসন নয়, রীতিমতো দেশটির একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক এই পরিবার। সিএনএন মানি সুইজারল্যান্ডের চার পরিচালকের মধ্যে তিনজনই বাংলাদেশের। এর মধ্যে দুজন হলেন রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। আরেকজন আরএসএ ক্যাপিটালের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সামির আহমেদ। সিএনএন মানি সুইজারল্যান্ডের ওয়েবসাইটে তাঁদের নামও দেওয়া আছে। সিএনএন মানি সুইজারল্যান্ড সিএনএনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দেশটিতে বাণিজ্য সংবাদ প্রচার করে থাকে।

সিকদার গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে, এমন কয়েকজন প্রথম আলোকে জানান, স্বাধীনতার পর জয়নুল হক সিকদার আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন। ওই সময়ে দেশটিতে তিনি ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর দেশে ফিরে আসেন। এখন তিনি ও তাঁর সন্তানেরা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছেন। তবে এসব অর্থের উৎস অজানা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমাদের রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। একটি পরিবার দেশের বাইরে এত সম্পদের মালিক হয়ে গেল, অথচ কোনো সংস্থা তা ধরতে পারল না। সরকারের পক্ষ থেকে টাকা পাচার ঠেকাতে শক্তিশালী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, এসব প্রভাবশালীর অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। না হলে এভাবে চলতেই থাকবে। অনেকে একেবারেই চলে যাবে।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অ্যার্টনি জেনারেল অফিসের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন। এসব সম্পদ দেশের হলে তারা সক্রিয় হয়ে তা ফেরত আনতে ভূমিকা রাখতে পারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক খতিয়ে দেখতে পারে, কোনো ব্যাংক থেকে এসব টাকা বের হয়েছে কি না।