রাজস্ব আয় : পাঁচ বছরে পার্থক্য ৪০ হাজার কোটি টাকা
প্রতি অর্থবছর শেষে জুলাই মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ঘটা করে রাজস্ব আদায়ের চিত্র তুলে ধরে। সংশোধিত লক্ষ্য কখনো কখনো আদায় হলেও বেশির ভাগ বছরেই ঘাটতি থাকে। তবে সংশোধিত লক্ষ্যের কাছাকাছি যাওয়ায় এনবিআরের কর্মকর্তারা সব সময় তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন।
কিন্তু অর্থবছর শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর সেই তৃপ্তির ঢেকুর মিলিয়ে যায়। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত চূড়ান্ত হিসাবে দেখা যায়, এনবিআরের দেখানো রাজস্ব আদায়ের চেয়ে আরও কম টাকা আদায় হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এনবিআরের আয় আসলে কত? এনবিআরের হিসাবে এক রকম তথ্য, আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে ভিন্ন রকম। এনবিআরের রাজস্ব আদায় নিয়ে প্রতিবছরই শত শত কোটি টাকার পার্থক্য থাকে।
এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব ঘেঁটে দেখা গেছে, গত পাঁচ অর্থবছরে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবের মধ্যে পার্থক্য সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, যতক্ষণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারিতে রাজস্ব আদায়ের টাকা জমা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই টাকা সরকারের হিসাবে আসবে না। শুল্ক-কর কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায় বাবদ যে চেক, পে–অর্ডার, চালানপত্র পান, সেটা ধরেই হিসাব করে থাকেন। এ ছাড়া করদাতার অগ্রিম করের টাকাও যোগ করেন তাঁরা। ফলে রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। তাঁর মতে, এনবিআর বাহবা পাওয়ার জন্য অনেক সময় রাজস্ব আদায়ের হিসাব বাড়িয়ে দেখায়। তাই এনবিআরের উচিত, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় যে হিসাব দেবে, সেটা ধরেই চূড়ান্ত রাজস্ব আদায়ের হিসাব করা।
কোন বছর কত পার্থক্য
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এনবিআরের হিসাবে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা যায়, এর পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। হিসাবের পার্থক্য ৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে এনবিআরের চেয়ে ৭১৫ কোটি টাকা কম আদায় দেখানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে। ওই অর্থবছরে এনবিআর ২ লাখ ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা আদায় দেখিয়েছিল।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি, ১৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকার পার্থক্য হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ওই বছর এনবিআর ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা আদায় করেছে। অন্যদিকে এনবিআর বলেছে, ওই বছর ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ কোটি টাকা আদায় করেছে। একইভাবে ২০১৫-১৬ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যথাক্রমে হিসাবের পার্থক্য হয় ৯ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ও ১১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ওই তিন বছরেই সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা হিসাবের পার্থক্য হয়।
>প্রতিবছরই রাজস্ব আদায় নিয়ে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে হিসাবের পার্থক্য থাকে
এনবিআর বেশি দেখায়, অর্থ মন্ত্রণালয় কম
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রের এই ধরনের সংবেদনশীল হিসাব একই রকম হওয়া উচিত। তাই সব পক্ষ মিলিয়ে একটি সমন্বিত হিসাবব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করেন তিনি। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শুল্ক-কর পরিশোধের ব্যবস্থা করা হলে এই পার্থক্য থাকবে না বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, এনবিআর অনেক সময় রাজস্ব আদায়ের টাকা দুবার হিসাবে নিয়ে ফেলে। যেমন উৎসে করের টাকা যেখানে কাটা হয়, সেই কর্মকর্তা একবার হিসাব করেন। আবার ওই করদাতা যে কর অঞ্চলের করদাতা, সেখানেও একবার হিসাব করা হয়।
কেন এমন হয়
কেন এমন হয়, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নানা কারণ পাওয়া গেছে। ২০০৮ সালে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবের পার্থক্যের কারণ খুঁজে বের করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। ওই কমিটির প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাস পর্যন্ত সরকারি হিসাবে কত টাকা জমা পড়ল, সেই ভিত্তিতে হিসাব করে থাকে। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব করে থাকে ওই অর্থবছরে কত টাকা আদায় হলো, সেই হিসাবের ভিত্তিতে। উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, জুন মাসের ভ্যাটের রিটার্ন ও টাকা জমা দেওয়া যায় ১৫ জুলাই পর্যন্ত। ব্যবসায়ীরা জুন মাস শেষে হিসাব–নিকাশ করে ভ্যাট রিটার্ন জমার সময় ভ্যাটের টাকা জমা দেন। তবে এনবিআর একটি অনুমাননির্ভর হিসাব জুন মাস শেষেই দিয়ে দেয়। ফলে প্রকৃত টাকা কম–বেশি হতে পারে। কিন্তু জুন মাসের টাকা জমা পড়ে জুলাই মাসে। অর্থ মন্ত্রণালয় ওই টাকা জুলাই মাসের আয় হিসাবে ধরে থাকে।
আবার অগ্রিম কর হিসাবে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান করের টাকা জমা দেন। পরে ওই ব্যক্তি পরের বছরের সঙ্গে অগ্রিম করের টাকা সমন্বয় করেন, ফলে আগের বছরের এনবিআরের হিসাবে গরমিল হয়ে থাকে।
এ ছাড়া একেকটি কর অঞ্চল নিজেরা উৎসে শুল্ক-কর আদায় করে, মাস শেষে ওই টাকা নিজেদের আদায় বলে ধরে এনবিআরে হিসাব পাঠায়। কিন্তু যেসব করদাতা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উৎসে কর আদায় করা হয়, তাঁরা নিজ নিজ কমিশনারেটে রিটার্ন দাখিলের সময় ওই উৎসে করের টাকা প্রদর্শন করেন। অনেক সময় ওই কমিশনারেটও সেটা নিজেদের আয় বলে ধরে নেয়। ফলে হিসাব বেশি হতে পারে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শুল্ক-কর বাবদ অনেক ভুয়া চালান জমা পড়ে। শুল্ক-কর কর্মকর্তারা পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়াই ওই টাকা নিজেদের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। পরে যখন চেকটি ভুয়া প্রমাণিত হয়, তখন এনবিআরের হিসাবে গরমিল হয়। জানা গেছে, ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ১ কোটি টাকা ভুয়া চেক দিয়ে মালামাল খালাস করে নিয়ে গিয়েছিলেন এক আমদানিকারক। পরে চেকটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। কিন্তু এর আগেই ওই ১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
বছর দশেক আগে এনবিআরের এক কর অঞ্চল উৎসে কর হিসেবে কয়েক কোটি টাকা আদায় করে। কিন্তু পরে ওই উৎসে কর সমন্বয় করে ফেরত নিয়ে যান করদাতারা। কিন্তু ওই কর অঞ্চল কর্তৃপক্ষ নিজেদের আদায় বলে উৎসে করের অর্থ নিজেদের হিসাবে যোগ করে ফেলে।