ধান কাটার হারভেস্টরের ব্যাপক বিক্রি, ভর্তুকি ৫০ ভাগ
করোনাভাইরাস ঠেকাতে দেশজুড়ে সাধারণ ছুটিতে অন্যান্য ব্যবসার পরিস্থিতি যখন খারাপ, তখন ধান কাটার যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টরের বিক্রি ব্যাপকভাবে বাড়ছে। দেশের কৃষিযন্ত্র খাতের শীর্ষস্থানীয় দুই কোম্পানির একটি জানিয়েছে, গত বছর তারা ৪০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর বিক্রি করেছিল, এ বছর তা ১ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় আরেকটি কোম্পানি জানিয়েছে, চাহিদা ব্যাপক। তাদের মজুতে থাকা হারভেস্টর বিক্রি শেষের পথে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বোরো মৌসুমে এবার মোট জমির ৫ শতাংশের ধান কম্বাইন্ড হারভেস্টর কাটা হবে, যা এতদিন মাত্র এক শতাংশের নিচে ছিল। এবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেওয়া সাধারণ ছুটির হাওরে ধান কাটতে শ্রমিকের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছিল। কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও অন্যান্য কৃষিযন্ত্র দিয়ে হাওরে পানি আসার আগেই দ্রুত ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত হাওরের প্রায় ৬২ ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে।
কম্বাইন্ড হারভেস্টরে ধান কাটার ক্ষেত্রে তিনটি সুবিধার কথা বলছেন কৃষক ও যন্ত্র বিপণনকারীরা। প্রথমত, হারভেস্টর দিয়ে দ্রুত ধান কাটা যায়। শ্রমিকের অভাব কোনো সমস্যা তৈরি করে না। দ্বিতীয়ত, হারভেস্টরে খরচ সাধারণ পদ্ধতিতে ধান কাটার প্রায় অর্ধেক। তৃতীয়ত, হারভেস্টরে কাটলে ফসলের ক্ষতি অর্ধেকের নিচে নেমে আসে।
সব চেয়ে বড় সুবিধা হলো, যেসব কৃষি উদ্যোক্তা অথবা কৃষক সমিতি হারভেস্টর কেনে, তাদের মোট দামের অর্ধেক ভর্তুকি দেয় সরকার। হাওরে এটা ৭০ শতাংশ। এর মানে হলো, জাপানের একটি ব্র্যান্ডের একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টর ২৮ লাখ টাকা দিয়ে কিনলে সরকার ১৪ লাখ টাকা দেয়। হাওরের কৃষকেরা ভর্তুকি হিসেবে পান ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর চীনা একটি ব্র্যান্ডের একটি হারভেস্টর ২০ লাখ টাকা দিয়ে কিনলে কৃষক ভর্তুকি পান ১০ লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) হাসানুজ্জামান কল্লোল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে ২০০ কোটি টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ১০০ কোটি টাকা মোটামুটি কৃষক পর্যায়ে চলে গেছে। বাকি ১০০ কোটিও ছাড় করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'হাওরে নতুন কিছু হারভেস্টর দেওয়া হয়েছে। আগের কিছু হারভেস্টর ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্র মেরামত করে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে দ্রুত ধান কেটে ফেলা যায়।'
দেশে এখন জাপানি ও চীনা কম্বাইন্ড হারভেস্টর বাজারজাত করে চার-পাঁচটি কোম্পানি। এর মধ্যে বাজার হিস্যার দিক দিয়ে এগিয়ে এসিআই মোটরস, যারা জাপানের ইয়ানমার ব্র্যান্ডের কম্বাইন্ড হারভেস্টর বাজারজাত করে। তাদের দুটি হারভেস্টরের একটির দাম সাড়ে ২৯ লাখ টাকা, অন্যটি ২৮ লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলেন, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত হারভেস্টর বিক্রির মৌসুম। আশা করছি, এবার এক হাজার ইয়ানমার হারভেস্টর বিক্রি হবে। এই এক হাজার হারভেস্টর এক মৌসুমে চার লাখ একর জমির ধান কাটতে পারবে। তিনি বলেন, সাধারণ সময়েও দেশে কৃষিতে ৪০ শতাংশ শ্রমিক সংকট থাকে। এই সংকটের একটা অংশ এবার সামাল দেবে হারভেস্টর।
এসিআইয়ের হিসাবে, সনাতনী উপায়ে এক একর জমির ধান কাটতে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা লাগে। হারভেস্টরে খরচ প্রায় অর্ধেক, ৫ হাজার টাকা। এক হাজার হারভেস্টরে এ ক্ষেত্রে সাশ্রয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সনাতনী পদ্ধতিতে ধান কাটতে ফসল নষ্ট হয় ১২ শতাংশের মতো। হারভেস্টরে তা ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এ ক্ষেত্রে যে ধান রক্ষা পায়, তার মূল্য ১০০ কোটি (১ হাজার হারভেস্টরে)।
সুব্রত রঞ্জন বলেন, সব মিলিয়ে এক হাজার কম্বাইন্ড হারভেস্টরে এক মৌসুমে ৩০০ কোটি টাকার বাড়তি সুফল পাবেন দেশের কৃষকেরা। ১০ মৌসুমে হারভেস্টরগুলো কৃষিতে ৩ হাজার কোটি টাকার মূল্য যোগ করবে।
কৃষি যন্ত্রের বাজারে আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেটাল গ্রুপ চীনের ওয়ার্ল্ড ব্র্যান্ডের হারভেস্টর বিক্রি করে। তাদের হারভেস্টরের দাম সাড়ে ২০ লাখ টাকা। সেটি কিনলে সরকার ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা টাকা ভর্তুকি দেয়।
মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজিদ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ভর্তুকি দেওয়ায় হারভেস্টর বিক্রি বাড়বে। কৃষিতে শ্রমিকের ঘাটতি সবসময়ই থাকে। যন্ত্র ব্যবহার করলে ধান কাটায় কৃষকের খরচ ৪০ শতাংশ কম হবে। এতে ধান আবাদ করে কৃষক লাভবান হবে। তিনি বলেন, এখন যন্ত্র দিয়ে ২ শতাংশেরও কম ধান কাটা হয়। ফলে এ ক্ষেত্রে অনেক দূর যাওয়ার সুযোগ আছে।
সাজিদ জামিল বলেন, সরকার ভর্তুকি দেওয়ার পরও বাকি টাকা এক সঙ্গে কৃষকেরা দিতে পারেন না। এ কারণে আমাদের বাকিতে দিতে হয়। এখন সাধারণ ছুটিতে টাকা সংগ্রহ করাও কঠিন।
চিটাগং বিল্ডার্স, আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ ও আবেদীন ইক্যুইপমেন্ট বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ছোট-বড় কম্বাইন্ড হারভেস্টর আমদানি করে।
কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে জমি চাষ ও সেচে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার ৯০ শতাংশের বেশি। ধান মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। পিছিয়ে ছিল ধান কাটা। সেখানে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মিজানুর রহমান এপ্রিলের মাঝামাঝিতে একটি হারভেস্টর কিনেছেন ২৯ লাখ টাকায়। এর মধ্যে ভর্তুকি পেয়েছেন সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। এখন তিনি হাওরে বোরো মৌসুমের ধান কাটছেন। দিনে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে তাঁর।
মিজানুর রহমান বলেন, বোরো ও আমন মিলিয়ে তিনটি মৌসুম পেলেই তার বিনিয়োগ উঠে যাবে। এতে লাগবে দেড় বছর। হারভেস্টরটি চালানো যাবে পাঁচ বছরের মতো।
কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষির যান্ত্রিকীকরণ এগিয়ে নিতে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল মনে করেন, একটি মাঠে একটি যন্ত্র নামলে সেটার সেবা নেওয়ার সুযোগ সব কৃষকই পান। যান্ত্রিকীকরণ কৃষকের খরচ কমায় এবং একটি ফসল শেষ করে আরেকটি ফসল চাষের মধ্যকার সময় কমিয়ে আনে। এ ছাড়া কৃষিভিত্তিক একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে। তিনি বলেন, কৃষকেরা যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, তখন সরকার ভর্তুকি না দিলেও দামী যন্ত্র কিনবেন। থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের মতো দেশে এভাবেই কৃষির যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে।