সাফল্য
দুঃসাহসের সুফল দারুণ
দেশে রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসর তৈরির মতো উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের সাহস দেখিয়েছিল দেশীয় কোম্পানি ওয়ালটন। এতে প্রতিষ্ঠানটি দারুণ সাফল্য পেয়েছে। বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও শুরু করেছে। ওয়ালটনের অধীনে এখন ১৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান আছে। তারা ফ্রিজের পাশাপাশি টেলিভিশন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ, মুঠোফোন, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য বিভিন্ন সরঞ্জাম, ইলেকট্রিক পণ্য, তার, রাসায়নিক, এলিভেটর বা লিফট, এলইডি বাতি ইত্যাদি তৈরি করে।
আপনার বাসায় যে রেফ্রিজারেটরটি আছে, সেটির মূল যন্ত্রাংশ কম্প্রেসর। হার্ট বা হৃদ্যন্ত্র যেমন মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে দেহকে সচল রাখে, তেমনি রেফ্রিজারেটরকে সচল রাখে কম্প্রেসর। দেশে কম্প্রেসর তৈরির একমাত্র কারখানাটি হচ্ছে ওয়ালটনের।
ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন কম্প্রেসর কারখানাটি স্থাপন করেছে ২০১৭ সালে। ওই বছর ৬ এপ্রিল গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে কারখানাটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
ওয়ালটন জানিয়েছে, তাদের কম্প্রেসর কারখানাটি বিশ্বে ১৫তম, এশিয়ায় অষ্টম। ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) গোলাম মুর্শেদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কম্প্রেসর কারখানা করে তাঁরা কি সাহস দেখিয়েছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে সাহস নয়, আমরা দেখিয়েছিলাম দুঃসাহস।’
তিন বছর আগে দুঃসাহস দেখানোর সুফল এখন পাচ্ছে ওয়ালটন। বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে ওয়ালটনের কম্প্রেসর। কিছুদিন আগেও তুরস্কে গেল তাদের কম্প্রেসরের চালান। রপ্তানির আদেশ আরও আসছে। সীমিত নয়, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ফলে ওয়ালটনের রপ্তানি আয়ের একটি বড় উৎস হতে যাচ্ছে কম্প্রেসর।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর রয়েছে—এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। তাদের দাবি, রেফ্রিজারেটরের বাজারে তাদের হিস্যা এখন ৭০ শতাংশের বেশি। আপনার ঘরে ওয়ালটনের টেলিভিশন (টিভি), রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ (এসি) অন্যান্য গৃহস্থালি সরঞ্জাম থাকতে পারে। কিন্তু আপনি হয়তো ওয়ালটনের ব্যবসা সম্পর্কে জানেন না। তাই একটু জানিয়ে রাখি।
১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে দেশে ইলেকট্রনিকসের বাজারে যাত্রা শুরু করে ওয়ালটন। তখন লক্ষ্য ছিল একসময় দেশেই কারখানা করা। ওয়ালটনের উদ্যোক্তা প্রয়াত এস এম নজরুল ইসলাম দ্রুতই সে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যান। ২০০৫ সালের শেষ দিকে ওয়ালটন গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জমি কিনে কারখানার কাজ শুরু করে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। কালিয়াকৈরেই ওয়ালটনের সব কারখানা। পুরো স্থাপনা এলাকাটির নাম ওয়ালটন হেডকোয়ার্টার্স। জমির পরিমাণ ৭৬৫ একরের বেশি, যা প্রায় ১৪টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সমান।
এখন ওয়ালটনের অধীনে ১৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান আছে। তারা ফ্রিজের পাশাপাশি টেলিভিশন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ, মুঠোফোন, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য বিভিন্ন সরঞ্জাম, ইলেকট্রিক পণ্য, তার, রাসায়নিক, এলিভেটর বা লিফট, এলইডি বাতি ইত্যাদি তৈরি করে। করোনাকালে তারা বিভিন্ন সুরক্ষা সরঞ্জামও উৎপাদন শুরু করেছে। দেশীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও তারা এখন রেফ্রিজারেটর, এসি, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানি করছে।
ওয়ালটন হাই-টেকের এএমডি গোলাম মুর্শেদ জানান, ওয়ালটন এখন দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্যের সার্বিক বাজারে তাদের হিস্যা ৭০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চায় তারা।
কম্প্রেসরে ওয়ালটন ১২ বছরের নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি দিচ্ছে। এত দীর্ঘ সময়ের জন্য নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব কীভাবে? জবাবে জানা গেল, তারা তাদের উৎপাদিত কম্প্রেসরের গুণগত মান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। সে কারণেই তারা নিশ্চয়তা দিতে পারছে। ওয়ালটন জানিয়েছে, তারা জার্মানিতে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে কম্প্রেসর তৈরি করছে। দেশের তরুণ ও মেধাবী শতাধিক প্রকৌশলীকে তারা ইউরোপ থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে এনেছে।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর দক্ষতার সমন্বয়ে আমরা বিশ্বমানের কম্প্রেসর ও এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছি। উৎপাদন পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি।মীর মুজাহেদীন ইসলাম, ওয়ালটন কম্প্রেসরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)
ওয়ালটন কম্প্রেসরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মুজাহেদীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর দক্ষতার সমন্বয়ে আমরা বিশ্বমানের কম্প্রেসর ও এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছি। উৎপাদন পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। কম্প্রেসর তৈরির পর তা ব্যবহারের আগে এর নির্ভরযোগ্য পারফরম্যান্স বা পারদর্শিতা নিশ্চিতে আমরা বিভিন্ন পরীক্ষা করে থাকি।’
তিনি জানান, পরীক্ষার মধ্যে একটি হলো ‘অন-অফ টেস্ট’, যার মাধ্যমে কম্প্রেসরের দীর্ঘ সময় ধরে চালু থাকা অবস্থায় এর যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেটি নিশ্চিত করা হয়।
এরপর ‘ওয়্যার টেস্ট’ নামে আরেকটি পরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে কম্প্রেসরে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের স্থায়িত্ব বা ডিউরেবিলিটি পরীক্ষা করা হয়। উল্লেখ্য, দুই হাজার ঘণ্টা ধরে ওয়ালটন কম্প্রেসরের ‘ওয়্যার টেস্ট’ করা হয়। এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল কম্প্রেসর ব্যবহারের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
ওয়ালটন জানিয়েছে, কম্প্রেসরে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাংশের গুণগত মান বজায় রাখতে বিশ্বমানের মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার, পরীক্ষার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। ওয়ালটন কারখানায় রয়েছে মাদারবোর্ড তৈরির জন্য নিজস্ব ইউনিট। ওয়ালটন কম্প্রেসর যাতে সবচেয়ে কম শব্দ করে, তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ‘হেমি অ্যান-ইকোয়িক অ্যাকুইস্টিক চেম্বার’ বসানো হয়েছে। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উৎপাদনের সময় এর গুণগত মানের দিক দিয়ে অতি সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা হয়। এ জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে জার্মানির বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের ‘কো–অর্ডিনেট মেজারিং মেশিন (সিএমএম)।
বর্তমানে ওয়ালটন কম্প্রেসর কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ লাখ ইউনিট। ২০২৫ সালের মধ্যে উৎপাদন সক্ষমতা এক কোটিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে তারা। ওয়ালটন জানিয়েছে, কারখানা চালুর পর থেকেই জার্মানিভিত্তিক বিশ্বের একটি খ্যাতনামা কম্প্রেসর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ যন্ত্রাংশ নিচ্ছে। চুক্তির শর্তের কারণে নামটি প্রকাশ করেনি ওয়ালটন। ইরাক, স্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কম্প্রেসর ও এর যন্ত্রাংশ রপ্তানি করছে ওয়ালটন।
ওয়ালটনের আন্তর্জাতিক বিপণন দল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলোতে বাজার সম্প্রসারণে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। ফলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে ওয়ালটন। এর মধ্যে রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতকারী বিশ্বখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যারা প্রতিবছর ওয়ালটনের কাছ থেকে ২০ লাখ কম্প্রেসর কিনতে আগ্রহী।
এদিকে অধিক কার্যক্ষম, হালকা ও সাশ্রয়ী মূল্যের একটি নতুন সিরিজের কম্প্রেসর তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে ওয়ালটনের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ। ২০২১ সালের শেষ দিকে নতুন সিরিজটি বাজারে ছাড়তে চায় তারা। এটির মাধ্যমে রপ্তানি বাজারে আরও ভালো করা যাবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ওয়ালটন জানিয়েছে, তাদের বিভিন্ন পণ্য বিশ্বের প্রায় ৩৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওয়ালটন পণ্যের নকশা, উৎপাদন এবং বৈশ্বিক বিপণন নিয়ে কাজ করছে ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল। ওয়ালটনের বিভিন্ন পণ্য সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরীক্ষা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এসজিএসের বিভিন্ন সনদ পেয়েছে।
বাংলাদেশে তৈরি পণ্য ইউরোপের কোনো দেশ বা আমেরিকা কেন কিনবে, জানতে চাইলে ওয়ালটন হাই-টেকের এএমডি গোলাম মুর্শেদ বলেন, ‘আমরা কম দামে দিতে পারছি। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হওয়ার পর বড় ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। আর মানের দিক দিয়েও আমরা পিছিয়ে নেই।’