খোলাবাজারের গতকাল প্রথমবারের মতো শতক হাঁকিয়েছে ডলার। গতকাল এ বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য একলাফে উঠে গেছে ১০২ টাকায়। পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ফলে আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে বাড়তি দাম। এতে চাপে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে আমদানিকারকেরা। যেসব ব্যবসায়ীর রপ্তানি আয় নেই, কিন্তু আমদানি করতে হয়, তাঁরা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছেন।
কারণ, আমদানির জন্য ব্যাংকে ডলার পাচ্ছেন না, পেলেও প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৯৪-৯৫ টাকা। কোনো কোনো গ্রাহককে ৯৭ টাকাও দিতে হচ্ছে। অপর দিকে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন বড় রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা। কারণ, রপ্তানি বিল নগদায়নে তাঁরা ভালো দাম হাঁকাচ্ছেন। প্রবাসীদের পরিবারও আগের চেয়ে বেশি আয় পাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের মতো স্বস্তি ও অস্বস্তি আছে ব্যাংকগুলোয়ও। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায়ের চেয়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেশি, তারা স্বস্তিতে আছে। বিশেষ করে কয়েকটি বড় ব্যাংক। আর যাদের আমদানি খরচ বেশি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কম, তারা অস্বস্তিতে আছে। বিশেষ করে ছোট ও নতুন ব্যাংকগুলো।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখনই আমদানি খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বড় উদ্যোগ প্রয়োজন।মাসরুর আরেফিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক
এদিকে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৮০ কোটি ডলার মজুত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডলার রয়েছে বিদেশি খাতের সিটি ব্যাংক এনএ, দেশীয় মালিকানার ইসলামী ব্যাংক, রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক এবং কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের কাছে।
ডলারের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে, ব্যাংকগুলো কত দামে প্রবাসী আয় আনতে পারবে ও রপ্তানি বিল নগদায়ন করতে পারবে, তা বেঁধে দিচ্ছে। একইভাবে আমদানি বিলের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তবে কোনো ব্যাংক এই দামে ডলার লেনদেন করতে পারছে না।
জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন উদ্যোগের পরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। ৯৭ টাকা দরেও আমদানি বিল সমন্বয় করতে হচ্ছে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বিলেও কাছাকাছি দাম দিতে হচ্ছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া বিনিময় মূল্যের চেয়ে ১০ টাকা বেশি। এই চাপের কারণে ডলারের আন্তব্যাংক লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখনই আমদানি খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বড় উদ্যোগ প্রয়োজন।’
দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ বা ডলার খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে তা মিটছে না। এর ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়েছে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া বাড়ার কারণে। ডলার–সংকট মোকাবিলায় বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আর সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাতিল করেছে সরকার।
তারপরও ডলারের সংকট সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভও কমছে। রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে। আর ডলারের বিনিময় মূল্য ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। গত সোমবার প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংকগুলো এখন ৯৪-৯৫ টাকায়ও প্রবাসী আয় আনছে। রপ্তানি বিলে নগদায়নেও ডলারের একই দাম দিচ্ছে।
কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজ নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কাগজের প্লেট, বাটি ও কাপ তৈরি করে। এ জন্য বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয় তাদের। ডলারের দাম বাড়ায় ৫০ টন কাঁচামালে প্রতিষ্ঠানটির খরচ বেড়েছে ৫ লাখ টাকা। কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান কাজী সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খরচ বাড়লেও পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। এর ফলে পুরো ব্যবসার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে।
ছোট ব্যবসায়ীদের মতো নতুন প্রজন্মের ও ছোট ব্যাংকগুলোও চাপে পড়ে গেছে। কারণ, এসব ব্যাংকের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কম। তাই ডলারের জন্য তাদের অন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের মিডল্যান্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান-উজ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে ডলার পাওয়া এখন কঠিন হয়ে গেছে। বেশি দাম দিয়েও খুব বেশি ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদেরও খরচ বেড়ে গেছে তাতে। যেসব ব্যাংকের প্রবাসী আয় ভালো, তারা ভালো অবস্থায় রয়েছে। আবার প্রবাসী আয়ের সুবিধাভোগীরা ভালো আয় পাচ্ছেন।’
এদিকে খোলাবাজারে ডলারের দাম প্রথমবারের মতো গতকাল ১০২ টাকায় পৌঁছেছে। দাম বাড়ার আশায় অনেকে এখন ডলার মজুত করছে। বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত একাধিক এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশি দাম দিয়েও বাজারে খুব বেশি ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, দাম বাড়তে থাকায় সবাই ডলার ধরে রাখছেন।