খাদ্য মজুত সামান্য
টাকা ছিল, তবু কেনা যায়নি চাল
কৃষকের কাছ থেকে আগামী সাড়ে তিন মাসে ধান-চাল মিলিয়ে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করবে সরকার।
ধান ২৭ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪০ টাকা এবং আতপ চাল ৩৯ টাকা কেজি দরে কেনা হচ্ছে।
ধান ও গম মিলিয়ে গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত খাদ্য মজুত ৪ লাখ ৬৮ হাজার টন।
সব সময়ের জন্য খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত ১০ লাখ টন রাখার সিদ্ধান্ত।
৩২০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৬১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৪২ হাজার টন।
সরকার দেশের সার্বিক খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। অসন্তুষ্টির মূলে রয়েছে তিনটি বিষয়—প্রথমত, চাহিদার তুলনায় কম খাদ্য উৎপাদন; দ্বিতীয়ত, চালের বাজারমূল্য বেড়ে যাওয়া এবং তৃতীয়ত, কম সরকারি মজুত। বাজারমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে খাদ্য সংগ্রহ করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে বাজেটে অর্থ বরাদ্দের পরও ৫ লাখ ৬৪ হাজার টন চাল আমদানি করা যায়নি।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে গত ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ আটজন মন্ত্রী এবং দশজন সচিব উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের কার্যবিবরণী ঈদের আগে অন্তত ২০টি দপ্তরে পাঠানো হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে দেশের পুরো খাদ্য পরিস্থিতি। ওই দিনের বৈঠকে মন্ত্রী ও সচিবদের কে কী বলেছিলেন, তা–ও তুলে ধরা হয়েছে কার্যবিবরণীতে।
কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়া, করোনা মহামারিতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সব সময়ের জন্য সরকারি মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে অর্থাৎ কমপক্ষে ১০ লাখ টন রাখার ব্যাপারে বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সরাসরিই বলে দেন, ‘খাদ্য সমস্যা হলে দেশ অস্থির হবে এবং কোনোভাবেই খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।’
আমদানি শুল্ক কমিয়েও বেসরকারি খাতকে চাল আমদানিতে ওভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি সরকার
খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও দাম প্রসঙ্গ
বৈঠকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৪ কোটি ১৬ লাখ টন খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে চাল ৩ কোটি ৬৬ লাখ, গম ১০ লাখ এবং ভুট্টা ৪০ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪ কোটি ৬৮ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ৩ কোটি ৯৮, গম ১৩ এবং ভুট্টা ৫৭ লাখ টন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, কৃষিজমি কমছে। তাই প্রতি ইঞ্চি কৃষিজমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আবাদি জমি কমে যাওয়ায় ধানের উৎপাদন কমছে। তা ছাড়া হিট শকের ফলে ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। দরকার এখন তাপ সহনশীল ও লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন।
বৈঠকে জানানো হয়, দেশীয় বাজারে চাল ও গমের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে আশার কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম এখন পড়তির দিকে।
খাদ্য মজুত যথেষ্ট নয়
খাদ্য অধিদপ্তর বৈঠকে জানায়, খাদ্য মজুত যা আছে, তা খুবই সামান্য। গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি খাতে ৪ লাখ ৬৮ হাজার টন খাদ্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার টন চাল এবং ১ লাখ ৫৮ হাজার টন গম।
খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, এ বছরের বোরোর মৌসুমে খাদ্য মজুত বাড়াতে হবে এবং করোনার পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্যসহায়তা দিতে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম বিস্তৃত করতে হবে।
অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী ২৪ লাখ ৫২ হাজার টন খাদ্য কেনার অর্থ রাখা হয়েছে। আর গত ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৮ লাখ ৮৮ হাজার টন খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। জুনের মধ্যে বিতরণ করতে হবে ৫ লাখ ৬৪ হাজার টন। এ ছাড়া ঠিক ৩০ জুনে নিরাপত্তা মজুত থাকতে হবে ১০ লাখ টন খাদ্য, যার মধ্যে ৮ লাখ টন চাল ও ২ লাখ টন গম। আর আগামী ছয় মাসে অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই চাল ও গম বিতরণের দরকার পড়বে ১৩ লাখ ৩৮ হাজার টন।
অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বৈঠকে বলেন, ‘চালের সংগ্রহ মূল্য বেশি হলে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, চাল পাচার হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।’ অর্থসচিবের এ আশঙ্কাকে অবশ্য নাকচ করে দেন কৃষিমন্ত্রী।
ভারতীয় চাল মন্থরগতিতে আসছে
সরকারিভাবে চাল আমদানির যেসব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে ১০ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বৈঠকে তথ্য দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক দরপত্র ও সরকার থেকে সরকার (জি টু জি) পর্যায়ে দেশে চাল পৌঁছেছে ৩ লাখ ২০ হাজার টন। তবে ভারত থেকে ছোট ছোট বার্জ ও জাহাজে করে আমদানির কারণে চাল আসার গতি অত্যন্ত মন্থর।
বলা হয়েছে, দেশে চালের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা ও চালের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৭ জানুয়ারি চাল আমদানির করভার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। এর অবশ্য মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত ৩০ এপ্রিল। বৈঠকে বলা হয়েছে, ৩০ এপ্রিলের পর আমদানি করা চাল বাংলাদেশে আসতে পারবে না। গত বৃহস্পতিবার খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি পর্যায়ে আর চাল আসছেও না।
বৈঠকে আরও জানানো হয়, এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের পর ৩২০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৬১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টনের। আর আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৪২ হাজার টন।
ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য বেড়েছে
বৈঠকে জানানো হয়, বোরো মৌসুম থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান, ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ১ লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহ করবে সরকার। ২৮ এপ্রিল থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ধান এবং ৭ মে থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগ্রহের সময়সীমা।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বোরো ধান ২৭ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪০ টাকা, আতপ চাল ৩৯ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। আগেরবারের চেয়ে তা কেজিতে ১ টাকার বেশি।
খাদ্যমন্ত্রী জানান, গত মৌসুমে বাজারমূল্যের চেয়ে সংগ্রহ মূল্য কম থাকায় বেশি চাল কেনা যায়নি। দেশে মাঝারি ও চিকন চালের আবাদ বেশি হওয়ায় খাদ্য মন্ত্রণালয় সেগুলোই কিনবে, মোটা চাল নয়। ‘বোরো সংগ্রহ অভিযান’ সফল করার পক্ষে তিনি।
বোরো সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়েছে বলে খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। কয়েক দিন ধরে দামও একটু বাড়তির দিকে।
খাদ্যশস্য ও কৃষি খাত নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেটে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও আগেরবার খাদ্যশস্য কেনা যায়নি। কারণ, এগুলো কেনা হয় মিলারদের কাছ থেকে, কৃষকদের কাছ থেকে নয়। মিলাররা সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দেয়, সরকার তখন আর কিনতে পারে না। এবারও সে আশঙ্কা আছে।’