ছোটদের বীজের বাজারে করপোরেটরা

এখন প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বীজ বিক্রি হচ্ছে।এর মধ্যে সব প্রতিষ্ঠান মিলে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বীজ বিক্রি করছে।এখনো বীজের চাহিদার সিংহভাগ জোগান দিচ্ছেন কৃষকেরা।

একটা সময় ধান বীজের পুরো উৎস ছিল গ্রামের কৃষক। কৃষকেরা নিজে বীজ সংরক্ষণ করতেন। সেই বীজ বিক্রি করতেন অন্য কৃষকের কাছে। আর শাকসবজি বীজের মূল উৎসও ছিল কৃষক। তবে বীজের উৎপাদন, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ফলন কম হতো। পরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বীজ নিয়ে কাজ শুরু করে।

সময়ের ব্যবধানে বীজ নিয়ে গবেষণা,উন্নয়ন ও উৎপাদনে যুক্ত হয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি শুরু করে। ফলে কৃষকের হাতে খোলা বীজের পরিবর্তে এখন পৌঁছে যাচ্ছে প্যাকেটজাত বীজ। যাতে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে বীজের বাজার। আর আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় প্যাকেটজাত বীজে বাড়ছে ধান ও সবজি উৎপাদন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বীজ ও উৎপাদিত শাকসবজি।

দেশে এখন বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বীজ বিক্রি করছে। এর মধ্যে শাকসবজি বীজ বিক্রি হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার। আর ধান বীজ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে আমদানি করা বীজের পাশাপাশি রয়েছে দেশে উৎপাদিত বীজও। তবে দামের পার্থক্য হওয়ায় ও হাতের নাগালে পাওয়ায় বীজের বাজারের বড় অংশ এখনো কৃষকদের হাতেই অর্থাৎ খোলা বীজের। ফলে সব মিলিয়ে প্রতিবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বীজ বিক্রি ও হাতবদল হচ্ছে। এখন সবজির বীজে নেতৃত্ব দিচ্ছে লাল তীর, ধান বীজে সুপ্রিম সিড ও ভুট্টায় ব্র্যাক।

বীজ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি বীজের জন্য পৃথক ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। বীজ উৎপাদন, বাছাই ও তাপমাত্রা সংরক্ষণ ব্যবস্থায় এখন আধুনিকায়ন হয়েছে। এ জন্য ফলন ভালো হচ্ছে। আর পেঁয়াজ, বাঁধা কপি, ফুলকপি,গাজর,ওল কপি বীজ পুরোটাই আমদানিনির্ভর। কারণ, দেশের তাপমাত্রায় ভালো বীজ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ জন্য বিদেশ থেকে বীজ আনছে বীজ খাতের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ভালো বীজ উৎপাদনে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। কারণ,কৃষির মূল উপকরণ বীজ।

যাদের হাতে শুরু

দেশ স্বাধীনের আগে থেকে এই অঞ্চলে বিদেশ থেকে বীজ আমদানি হতো। তখন মতিঝিলে ঢাকা সিড স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান বীজ আমদানি করত। দেশ স্বাধীনের পরও যা অব্যাহত ছিল। যার কর্ণধার ছিলেন আলী আহমেদ।

১৯৭২ সালে বীজ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় ইউনাইটেড সিড । তবে আমদানি শুরু করে ১৯৭৮ সালে। আর ১৯৯২ সাল থেকে দেশে উৎপাদন শুরু করে। ইউনাইটেড সিড এখন বিভিন্ন শাক, বড় বটি, শসা, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙে বীজ উৎপাদন করছে।

দেশে ১৯৯৫ সালে গবেষণার মাধ্যমে বড় আকারে বীজ উৎপাদন শুরু করে লাল তীর সিড লিমিটেড। এখন পর্যন্ত ৩২ ধরনের সবজির ২০০টি নতুন জাত উদ্ভাবন ও বাজারজাত করেছে। শুরুতে লাল তীর পরিচিত ছিল ইস্ট ওয়েস্ট সিড নামে। ২০০৭ সালে নাম পরিবর্তন করে। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে সবজির বীজের উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। শুধু দেশে নয়, বীজ রপ্তানি করছে বিদেশেও। দেশের বাইরে আফ্রিকায়ও কৃষকদের নিয়ে নতুন ধরনের বীজ উৎপাদন ও বীজের উন্নয়নে কাজ করছে লাল তীর। আর এসব কার্যক্রমে লাল তীর সহায়তা নিচ্ছে দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়, বীজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বিশ্বসেরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।

এর ফলে ‘একসেস টু সিড ইনডেক্স’ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে লাল তীর সিডের অবস্থান সপ্তম, গত ২২ নভেম্বর এ তালিকা যা প্রকাশ করা হয়। আগে লাল তীরের অবস্থান ছিল ১৩তম। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই অবস্থান করে নিয়েছে লাল তীর। লাল তীরের কার্যক্রম শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

লাল তীরের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন,‘লাল তীরের উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা নয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য বীজের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও সব সময়ে উৎপাদন উপযোগী বীজ তৈরি করা। যাতে আমরা সফলও হয়েছি। এখন সারা বছর সবজি পাওয়া যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।’

এখন শীর্ষে যারা

দেশ স্বাধীনের পর হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায় যুক্ত হলেও ৯০–এর দশকের পরে এই খাতের বড় বিকাশ হয়। এরপর অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠানও এই খাতে যুক্ত হয়। পাশাপাশি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠান। ফলে এখন দেশের প্রায় ২০০ ছোট বড় প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তবে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গবেষণার মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করে বীজ উৎপাদন করছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ভালো উৎপাদন হয়, এমন বীজ বাজারে মিলছে। যাতে মিটছে স্থানীয় চাহিদা। শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।

বীজ খাতে এখন উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো লাল তীর,এসিআই, ইউনাইটেড, জামালপুর সিড, সুপ্রিম,এআর মালিক, মেটাল, মল্লিকা, ব্র্যাক, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, ইস্পাহানি, ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার, পারটেক্স সিড, কৃষিবিদ সিড, গেটকো ও ব্যাবিলন সিড।

মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল প্রথম আলোকে বলেন,‘কৃষকেরা একসময় নিজে বীজ সংরক্ষণ করতেন। অন্য কৃষকেরা তা কিনত। তবে বীজের উৎপাদন ও সংরক্ষণ নিয়মকানুন মেনে করতে হয়, যা আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো করছে। এর ফলে কৃষকেরা মানসম্পন্ন বীজ পাচ্ছে। এতে সবজি ও কৃষির ভালো ফলন হচ্ছে। আমরা দেশে বিক্রির পাশাপাশি এখন রপ্তানিও করছি।’

ব্যবসা কত টাকার

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশে শাক-সবজি, ধান, গম, ভুট্টা, পাট, চা, তামাকসহ বিভিন্ন বীজ বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকার বীজ সরবরাহ করেছে বিভিন্ন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও আমদানিকারকেরা। আর বাকি বীজ সরবরাহ করেছে কৃষকেরা ও স্থানীয় সংগ্রহকারকেরা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বীজ প্যাকেটজাত ও কৃষকদের বীজ হয় খোলা।

বীজের বাজারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। শাকসবজি বীজ ও ধান, গমসহ অন্যান্য বীজ। বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলে শাকসবজি বীজ বিক্রি করছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। হাইব্রিড ধান বীজ বিক্রি করছে এক হাজার কোটি টাকার।

সবজিবীজ বিক্রিতে দেশে শীর্ষে লাল তীর, প্রায় ৩২ শতাংশ। এরপর মেটাল ১৩ শতাংশ, জামালপুর সিড ১২ শতাংশ, এসিআই ৮ শতাংশ, ইউনাইটেড সিড ৫ শতাংশ, সুপ্রিম সিড, মল্লিকা সিড ও এ আর মালিক ৩ শতাংশ করে।

ধানবীজ বিক্রিতে দেশে শীর্ষ সুপ্রিম সিড, প্রায় ১৮ শতাংশ। দেশের বিক্রি হওয়া প্যাকেটজাত ধানবীজের মধ্যে বায়ার ক্রপসের ৯ শতাংশ, এসিআইয়ের ৮ শতাংশ, ব্র্যাকের ৮ শতাংশ, ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের ৮ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের ৬ শতাংশ, লাল তীরের ৫ শতাংশ, ইস্পাহানির ৪ শতাংশ, পারটেক্স সিডের ২ শতাংশ।

আর বীজ আমদানিতে শীর্ষে এ আর মালিক, প্রায় ১৮ শতাংশ, ইউনাইটেড ১৭ শতাংশ, মাসুদ সিড ১২ শতাংশ, মল্লিকা ও সুপ্রিম ৯ শতাংশ করে, জামালপুর সিড ৫ শতাংশ, লাল তীর ৩ শতাংশ, কাশেম সিড ৩ শতাংশ, এসিআই ৩ শতাংশ, গেটকো ২ শতাংশ।

এসিআই অ্যাগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এইচ আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকেরা এখন উচ্চ মানের বীজ পাচ্ছে। এ জন্য ভালো ফলন হচ্ছে। দেশে মানসম্পন্ন সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ভারতের চেয়ে হেক্টর প্রতি বেশি ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে। ধানেরও ভালো উৎপাদন হচ্ছে। কৃষকও এখন প্যাকেট বীজে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এর ফলে যারা এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে, তাদেরও ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালে লাল তীর ৩৫০ কোটি টাকার, ইউনাইটেড ২৫০ কোটি টাকা, এসিআই ১৭০ কোটি টাকা, ব্র্যাক দেড় শ কোটি টাকা, সুপ্রিম ১২০ কোটি টাকা, এ আর মালিক ১২০ কোটি টাকা, মেটাল ৬০ কোটি টাকার বীজ বিক্রি করে।

ইউনাইটেড সিডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন,‘এখন বীজ বাজারের বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে। পাশাপাশি কৃষকেরা স্থানীয় ভাবে বীজ উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি খাতের বীজ উন্নয়ন ও উৎপাদন নিয়ে কোন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। আমরা নিজেরাই গবেষণার মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করে উৎপাদন করছি। এর সুফল পাচ্ছে দেশের জনগণ। আগে শীতকালের সবজি অন্য সময় পাওয়া যেত না। এখন সবজি সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। এটা বেসরকারি খাতের অবদান।’

এদিকে লাল তীর ও মেটাল এখন বিদেশে বীজ রপ্তানি করছে। আর সরকার বীজ রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এ জন্য আরও অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। তবে বীজ কোম্পানিগুলোর করপোরেট কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করায় অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। তারা বলছেন,এই খাতে ব্যবসায় মুনাফা খুবই কম। এর মধ্যে এত কর হলে অনেকেই নিরুৎসাহিত হবেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিতে বেসরকারি খাতের বীজ উৎপাদকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা এখন সময়ের দাবি।

এ আর মালিক সীডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন ১২ মাসে সবজি পাওয়া যাচ্ছে।কৃষকেরা এখন ভালো বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখে চলছে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।আমরা গবেষণার মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করেছি।সব সময়ে ফলন উপযোগী বীজ এনেছি।’