দেশের স্বাস্থ্য খাতের ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা এখন আর কারও অজানা নয়। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এসে এ খাতকে প্রায় তছনছ করে দিয়েছে। চোখে আঙুল দিয়ে কোভিড এখনো দেখিয়ে যাচ্ছে যে এ খাতে সংস্কার জরুরি, সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি।
সর্বজনীন বিমা ব্যবস্থা চালুর দাবিও আছে বহু বছর ধরে। আর আছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর কথা। পাঁচ বছর ধরে শোনাই যাচ্ছে এটি হবে। কিন্তু হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে বিচ্ছিন্নভাবে এগুলো নিয়ে কথা থাকছে। কিন্তু বড় আকারের সংস্কার বা দিকনির্দেশনা বা আমূল পাল্টে দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ থাকছে না।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) স্বীকৃত যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় নাগরিকেরা আর্থিক অসচ্ছলতা থেকে মুক্ত না হয়েও স্বাস্থ্যসুবিধা পেতে পারে, সেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই বলা হয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা। ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) সংক্রান্ত প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে এসেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউএইচসির পক্ষে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে সেই দেশ, যে দেশে রোগীদের পকেটের টাকায় চিকিৎসা খরচ হয় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবায় সরকারের খরচ হয় ২৮ শতাংশ, আর বাকি ৭২ শতাংশ খরচই হয় রোগীদের পকেটের পয়সায়।
যোগাযোগ করলে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রতিষ্ঠাতা মোশতাক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা জগাখিচুড়ির মতো। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউএইচসি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে সমগোত্রীয় শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও মরক্কো ইউএইচসি বাস্তবায়ন করেছে। থাইল্যান্ড ২০০২ সালে যখন ইউএইচসি বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের জাতীয় আয় বর্তমান বাংলাদেশের সমানই ছিল।
সর্বজনীন বিমা
২০১৫ সালে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় বেতন কমিশনে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিমা পলিসি চালুর সুপারিশ ছিল। গত দুই জেলা প্রশাসক সম্মেলনে আবার বিষয়টি সামনে আসে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটিও করা হয়। এই কমিটি জীবন বীমা করপোরেশনের সহায়তায় একটি প্রতিবেদন দাখিল করে, তা-ও আটকে আছে।
২০১৯ সালের ২০ জুন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্যবিমা চালুর পরিকল্পনা করছে।
বিশ্বের অনেক দেশে বাধ্যতামূলক থাকলেও বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক নয়। অথচ দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। আর জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে। এই বয়সের মানুষদেরই অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা ও সুযোগ বেশি থাকে। ফলে কর্মক্ষমতাসম্পন্ন এই জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে দরকার সুপরিকল্পিত আর্থিক নিরাপত্তা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ কারণেই দরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক করা ছাড়া উপায় নেই। তবে প্রথম দিকে গ্রুপ ধরে এগোনো যায়। এই সময়ে ভাবা যেতে পারে মোবাইল গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসে ১০ টাকা করে প্রিমিয়াম নিয়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু করা। তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ বাংলাদেশিরই চিকিৎসা ব্যয় করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। চিকিৎসা ব্যয়ের একটি সহজ সমাধান হতে পারে বিমা। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের জানা-বোঝার অভাবের কারণে নীতিই গ্রহণ করা হচ্ছে না।
সর্বজনীন পেনশন
দেশে একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর কথা সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে আসছিলেন ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে। পেনশন কার্যক্রমের সংস্কার আনতে ২০১৭ সালে বিদ্যমান গণকর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪ এবং এ-বিষয়ক বিধি সংশোধনের উদ্যোগও নিয়েছিল সরকার। এটি আর হয়নি। তবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার জন্য একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ। সেখানে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশসহ তা পরিচালনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি আর এগোচ্ছে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী ও কিছু বেসরকারি সংস্থার কর্মচারী মিলে সাত থেকে আট লাখ পরিবার বর্তমানে নিয়মিত পেনশন পাচ্ছে। এর বাইরে হতদরিদ্র ৩৫ লাখ লোক মাসিক ৫০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন, যা দেশের মোট বয়স্ক লোকের ৪ ভাগের ১ ভাগ।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বয়স্ক লোকদের কথা ভেবেও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা যায়। কয়েক বছর ধরে আমরা এ ব্যাপারে কথা শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবে কিছুই দেখছি না।’