খেলাপি ঋণ বাড়ছে বেসরকারিতেও
একসময় শুধু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণেই বড় অনিয়ম হতো। তাই ঋণখেলাপি ব্যাংকের তালিকায় ওপরের দিকে থাকত এসব ব্যাংকের নাম। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংকের ঋণে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। এসব ঋণ আদায়ও করা যাচ্ছে না। পুনঃ তফসিল করলেও তা আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে, তার বেশির ভাগই বেসরকারি খাতের। ব্যাংকগুলোর ২০১৮ ও ২০১৯ সালের জুনভিত্তিক খেলাপি ঋণের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
গত জুন শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। ফলে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে সরকারি ব্যাংকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় ব্যাংকটির এমন অবস্থা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদ বলেন, বেশ কিছু খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। আরও কিছু পুনঃতফসিলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক বছরে বেড়েছে ৫ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বড় ঋণগ্রাহক সিটিসেল, বিল্ডট্রেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে উদ্যোক্তারা ব্যাংকটিকে ঠিক করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তার অংশ হিসেবে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী। স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন আরেক সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী, তবে সম্প্রতি তাঁকে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেছে সরকার।
জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের এমডি তারিক আফজাল প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণের এসব তথ্য সঠিক নয়। গত জুনে খেলাপি ঋণ কমে ৩ হাজার কোটিতে নেমেছে। গত ডিসেম্বরে যা ৭ হাজার কোটি টাকা ছিল। সিটিসেল ও বিল্ডট্রেডের ঋণ নবায়ন হয়েছে। নগদ টাকাও আদায় হয়েছে।
এদিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবির পরেই রয়েছে ফারমার্স ব্যাংক, ব্যাংকটির নাম বদল করে এখন পদ্মা ব্যাংক করা হয়েছে। গত অর্থবছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা। বেসরকারি এ ব্যাংকটি বাঁচাতে সরকারের উদ্যোগে মালিকানায় যুক্ত হয়েছে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, জনতা ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ। এরপর নামও বদল হয়েছে। তবে পরিস্থিতির এখনো তেমন উন্নতি হয়নি।
বেসরকারি ওয়ান ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪১ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬২৭ কোটি টাকা। ইসলামি ধারার এ ব্যাংকটি ভালোই চলছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবরে হঠাৎ করেই ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়। এরপর থেকেই ব্যাংকটির পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে।
ঋণ জালিয়াতির কারণে বিপর্যয়ে পড়া বেসিক ব্যাংক দিন দিন আরও খারাপ হয়ে পড়ছে। গত অর্থবছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৭০ কোটি টাকা। ফলে গত জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত অর্থবছরে বেড়েছে ৫৯১ কোটি টাকা। ব্যাংকটি গত বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সীমা অতিক্রম করেও বেশি ঋণ বিতরণ করে। তবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত অর্থবছরে কিছুটা কমেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলো পরিচালকদের ইচ্ছায় চলছে। এ জন্য এমডিরা নিয়মকানুন মেনে ঋণ বিতরণ করতে পারছেন না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন—এ ছয় মাসেই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এপ্রিল-জুন—এ তিন মাসে বেড়েছে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর সঙ্গে অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঋণখেলাপিরা নতুন নতুন সুযোগ পাবেন—এমন ঘোষণায় ভালো অনেক ব্যবসায়ীও ঋণ শোধ করছেন না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি দুর্বলতায় ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়ছে।