>বছরজুড়ে সর্বাধিক আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত। শুরুটা হয় ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বদল দিয়ে। আর বছরের শেষ দিকে এসে ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের একাধিক সদস্য। এ ছাড়া মালিকানা বদলের কারণে আলোচনায় আসে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকও। বছরটিতে সাধারণ মানুষকে ভুগিয়েছে চাল, পেঁয়াজ ও সবজির দাম। নানা হুমকি-ধমকির পরও কার্যকর করা যায়নি নতুন ভ্যাট আইন
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ১১ বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ২০০৬ সালে সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে রাখা টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা। একই ঘটনা এবার নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকে। চলতি বছর ব্যাংক খাতে বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তনের ঘটনা থাকলেও বছর শেষে ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনা সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অতিরুগ্ণ হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ারও বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত হওয়া ওই শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক হয়, তবে এখনো পুরো টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা।
এ ছাড়া চলতি বছর বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা, ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন হয়। এতে করে অন্য ব্যাংকগুলোও এখন ভয়ের মুখে। পাশাপাশি অনিয়মের কারণে সরে দাঁড়াতে হয় নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি)। বেসিক ব্যাংকের আলোচিত কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে অবশেষে আদালতের নির্দেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকতে বাধ্য হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কেলেঙ্কারির পাশাপাশি বছরজুড়ে দুঃসংবাদ ছিল প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে। তবে সুখবর ছিল আমদানি বাণিজ্যে। বেড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ।
বছরজুড়ে ব্যাংক খাতের নানা ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংক আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনল। তারা গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, ফলে সব ব্যাংকের জন্য বদনাম হয়ে গেল। বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের নিয়ন্ত্রক। তবে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। সঠিক সময়ে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকটি ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া হলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না।’
নজরুল ইসলাম মজুমদার আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতে যা কিছু খারাপ হয়েছে, সবকিছুর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকই দায়ী। ২০১৭ সালে বিনিয়োগ বেড়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে, তবে ফারমার্সের দেউলিয়া হওয়ার ঘটনা সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।’
এদিকে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, টাকা ফেরত না পাওয়ার ঘটনা ব্যাংক ও গ্রাহকের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে গ্রাহকের আস্থায় কিছুটা চিড় ধরেছে।
পরিবর্তন ইসলামী ব্যাংকে
বছরের শুরুতে ৫ জানুয়ারি রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলে অনুষ্ঠিত এক সভায় ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন হয়। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ব্যাংকটির সে সময়ের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এর মাধ্যমে মূলত ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার হাতবদল হয়। ব্যাংকটির কর্তৃত্ব নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপ। এরপর ধাপে ধাপে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় আরও পরিবর্তন আসে। ব্যাংকটির মালিকানা থেকে সরে যায় বিদেশি বেশ কিছু উদ্যোক্তা।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকেও পরিবর্তন
বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে ইসলামী ব্যাংকের মতো একই ধরনের বদল ঘটে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডেও (এসআইবিএল)। গত ৩০ অক্টোবর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হঠাৎ করে পদত্যাগে বাধ্য হন। রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত এক সভায় এ পরিবর্তন ঘটে। তাতে ইসলামী ব্যাংকের মতো এসআইবিএলেরও কর্তৃত্ব চলে যায় চট্টগ্রামভিত্তিক ওই শিল্প গ্রুপের হাতে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ফারমার্সে
২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। কার্যক্রম শুরুর বছর না পেরোতেই বড় অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। দুর্বল হতে থাকে ব্যাংকের অবস্থা। তাতে আস্থার সংকট দেখা দেওয়ায় আমানতকারীরা অর্থ তোলা শুরু করেন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে গত ২৭ নভেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী। এমনকি পরিচালক পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তাঁরা। এরপর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার দায়ে ১৯ ডিসেম্বর ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটিতে জমা রাখা অর্থ তুলতে গিয়ে আমানতকারীদের বেশির ভাগকেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। অনেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়েও টাকা পাচ্ছেন না। এতে পুরো ব্যাংক খাতে একধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগ না দিয়ে এখন শেয়ার ছেড়ে মালিকানায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এতে সায় দিয়েছে। ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে যেভাবে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল, সেই মডেল অনুসরণের চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আলোচনায় এনআরবি কমার্শিয়ালও
ফারমার্স ব্যাংকের একই সময়ে নতুন ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন পাওয়া এ ব্যাংকটিতেও ঘটে গুরুতর ঋণ অনিয়ম। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭০১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম খুঁজে পায়। অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির মূলধন সংগ্রহেও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ ডিসেম্বর পরিবর্তন আসে ব্যাংকটির পরিচালনায়। প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ফরাছত আলীকে সরিয়ে দায়িত্বে আসেন তমাল এস এম পারভেজ। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যানকেও সরানো হয়। ছুটিতে পাঠানো হয় এমডি দেওয়ান মুজিবর রহমানকে।
দুদকে বাচ্চু
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম। ২০১৪ সালে ব্যাপক লুটপাটের পর ব্যাংকটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়লে তাঁকে নিরাপদে পদত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা অনিয়মের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে তাঁকে বিচারের আওতায় আনার দাবি তোলা হলেও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে দুদক ৪ ও ৬ ডিসেম্বর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। দুদকের ডাকে শুনানিতে অংশ নেন বহুল আলোচিত বাচ্চু।