দেশের বাজারে যখন ক্ষীরশাপাতি (হিমসাগর) ও ল্যাংড়ার মতো সুস্বাদু ও বিখ্যাত জাতের আমের সরবরাহ বেড়ে যায়, তখনই মনে করা হয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ভরা মৌসুম চলছে। সে হিসেবে সপ্তাহখানেক আগে হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমের মৌসুম শুরু হয়েছে।
‘যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই শুধু আম আর আম’—এটাই ভরা মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছবি। কিন্তু চিরচেনা এই রূপ এবার নেই। স্থানীয় কৃষি বিভাগ, আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার আমের ফলন কম হয়েছে। তবে ফলন কম হলেও দাম প্রায় দ্বিগুণ।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিন লাখ মেট্রিক টনের বেশি আম উৎপাদিত হবে, যার বাজারমূল্য আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। অন্যদিকে চাষিদের সংগঠন কৃষি অ্যাসোসিয়েশন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নেতারা বলেন, উৎপাদনের পরিমাণ চার লাখ মেট্রিক টন হবে। তাঁরা জানান, শিবগঞ্জে আমের উৎপাদন কম হলেও গোমস্তাপুর, নাচোল ও সদর উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের কম বয়সী গাছে ফলন কম হয়নি। দাম দ্বিগুণ হওয়ায় এ অঞ্চলের চাষিরা লাভবান হবেন।
সরেজমিনে গত বুধবার দেশের বৃহত্তম আমের মোকাম শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বাজারে গিয়ে প্রচুর সরবরাহ দেখা গেছে। সেখানে শিবগঞ্জ উপজেলার আজমতপুর গ্রামের মনিরুল ইসলাম, হাজারবিঘি গ্রামের মো. ইসমাইল, পৌর এলাকার রমজান আলীসহ আরও কয়েকজন আমচাষি ও ব্যবসায়ী জানান, এখন আমের ভরা মৌসুম চলছে। বাজার দেখে বোঝা যাবে না আমের উৎপাদন কম হয়েছে। বাগানে গেলে সেটা বোঝা যাবে। আসলে এবার আমের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বড়জোর অর্ধেকের মতো হবে। তবে দাম গতবারের দ্বিগুণ।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, গতবার যেখানে প্রতি মণ ক্ষীরশাপাতি তথা হিমসাগর ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেখানে এবার শুরুই হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এখন তো প্রতি মণ হিমসাগর তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়েক দিন আগে তা সাড়ে চার হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ল্যাংড়া আম বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ। গতবার এই সময়ে ল্যাংড়ার দাম ছিল প্রায় অর্ধেক।
গোমস্তাপুর উপজেলার আম ব্যবসায়ী মো. পলাশ জানান, কানসাট আমবাজারে ৫২ কেজিতে মণ হিসাব করে আমা বেচাকেনা হয়। আর গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরের আমবাজারে প্রতি মণে ৫৮ কেজি। সে জন্য কানসাটে আম নিয়ে এসেছেন।
ঢাকা থেকে আসা আমের ব্যাপারী মো. হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার আমের দাম দ্বিগুণ। তাই ঢাকার বাজারে আম নিয়ে গিয়ে লাভ হচ্ছে খুবই কম।
কানসাট আম আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক জানান, এই মোকাম থেকে প্রতিদিন ২৫০ ট্রাক আম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। প্রতি ট্রাকে সাধারণত ৩০০ মণ আম নেওয়া হয়। এ ছাড়া বাগান থেকে ট্রাকভর্তি আম যায়।
শিবগঞ্জ ম্যাঙ্গো প্রডিউসার কো–অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও শীর্ষস্থানীয় আমচাষি ইসমাইল খান শামীম জানান, শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রতিদিন প্রায় ৫০ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হয়। এখন অনলাইনেও প্রচুর আম বিক্রি হয়।
এ ছাড়া গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরের আমের মোকামও বেশ বড়। ভোলাহাট উপজেলার আমবাজারটিও ছোট নয়। জেলা শহরেও রয়েছে আমের বাজার। কানসাট, রহনপুর, ভোলাহাট ও জেলা সদর মিলিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হয় বলে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা দাবি করেন।
কৃষি অ্যাসোসিয়েশন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক মুঞ্জের আলম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি বিভাগ আমের উৎপাদন যে পরিমাণ দেখায়, তা প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে কম। কেননা এখন বরেন্দ্র অঞ্চলেও আমের উৎপাদন হচ্ছে প্রচুর। এই জেলায় আমের প্রকৃত উৎপাদন চার লাখ মেট্রিক টনের কম হবে না, যার বাজারমূল্য হবে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা।
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছরের তুলনায় আমের উৎপাদন কম হয়েছে বটে। তা সত্ত্বেও উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন। এর বাজারমূল্য আড়াই হাজার কোটি টাকা হবে।