মুহাম্মদ আজিজ খান: শিকড় থেকে শিখরে

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইতিহাস বদলে দেওয়া সফল উদ্যোক্তার নাম মুহাম্মদ আজিজ খান। তিনি সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও জ্বালানি খাত, তথ্যপ্রযুক্তির যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, বন্দর অবকাঠামো ব্যবসায় সফলতা দেখাচ্ছে সামিট। সিঙ্গাপুরের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল ভারতের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেছে ইতিমধ্যে। কোরিয়া, নেপাল ও ভুটানে বিনিয়োগের জন্য চলছে আলোচনা।

দেশে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে সামিট গ্রুপের। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে তাঁদের। বিনিয়োগের জন্য সব সময় বৈশ্বিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন আজিজ খান। বিপুল বিনিয়োগের উৎস হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়েছেন তিনি। আর এটি সফল করতেই স্থায়ী হয়েছেন সিঙ্গাপুরে। সামিট সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত হয় ২০১৫ সালে। কাজ শুরু করে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে। বিশ্বের বড় করপোরেটদের পছন্দের ওই দেশটিতে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে অংশীদার করেছেন আমেরিকার জিই করপোরেশন, জাপানের জেরা, মিতসুবিশি ও তাইয়ো লাইফ ইনস্যুরেন্সের মতো কোম্পানি।

বিদেশের টাকায় দেশে বিনিয়োগ

বেসরকারি খাতে দেশের প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর কিছুটা শ্লথগতিতে এগোতে থাকে খাতটি। ২০০৯ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে শুরু হয় বেসরকারি খাতের দুর্বার অগ্রযাত্রা। আর এখন দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মালিকানা বেসরকারি খাতের হাতে। যাঁর হাত ধরে এর সূচনা, তাঁর হাতে এখন ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা। এই মালিকানার মূল্যায়নের ভিত্তিতে দেশে ও বিদেশে শীর্ষ ধনীদের কাতারে এসেছেন আজিজ খান।

সামিট বলছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক রাজধানী হচ্ছে সিঙ্গাপুর। দেশের তুলনায় সেখানে সুদের হার কম। বিপুল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটি খুব বড় ভূমিকা রাখে। সুদের হারে ২ শতাংশ পার্থক্য মানে বিরাট ব্যাপার। এর ফলে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এসব চিন্তা থেকেই সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়িক নিবন্ধন করা হয়েছে।

দেশের বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লম্বা সময় ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আজিজ খান। গত ২৬ বছরে উন্নতির পথ ধরে এখন সামিটের ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা মোট ২ হাজার ২৫৫ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৯ শতাংশ তাঁর হাতে। আর বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১৯ শতাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। আরও এক হাজার মেগাওয়াট শিগগিরই যুক্ত হবে সামিটের বহরে।

বছরে এখন প্রায় আট শ কোটি টাকা আয় করছে সামিট গ্রুপ। দেশের পুঁজিবাজারে সামিটের তিনটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত। এগুলো হচ্ছে সামিট পাওয়ার, সামিট পোর্ট অ্যালায়েন্স ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল)।

ভাস্কর্য পার্কে হামিদুজ্জামান খান ও মুহাম্মদ আজিজ খান

শুরুর পুঁজি ৩০ হাজার টাকা

১৯৭১ সালে, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর শুরু হয় দেশ পুনর্গঠন। ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। এমন এক সময়েই কয়েকজন বন্ধু মিলে ১৯৭৩ সালে পুরান ঢাকায় জুতা তৈরি শুরু করেন আজিজ খান। এসব জুতার একটি অংশ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড বাটা কোম্পানিকে সরবরাহ করতেন তিনি। এর সূত্র ধরে তৎকালীন বাটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একদিন নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান তাঁকে। ব্যবসা নিয়েও আলোচনা হয়। নিজেদের তৈরি সব জুতা বাটায় সরবরাহ করতে রাজি হয়ে যান আজিজ খান। এরপর বাটার গুণগত মান বজায় রেখে জুতা তৈরি করে সরবরাহ করতে থাকেন তিনি।

ব্যবসার এ যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর পড়তে পড়তেই ব্যবসায় নামেন। পুঁজি হলো বাবার কাছ থেকে নেওয়া ৩০ হাজার টাকা। পিভিসি (পলি ভিনাইল ক্লোরাইড) দিয়ে জুতা তৈরির মধ্য দিয়ে যার শুরু। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাবার পুঁজি ফেরত দিয়ে ব্যবসায়িক অগ্রযাত্রা বিস্তৃত করতে থাকেন। জুতা তৈরির পাশাপাশি পিভিসি আমদানি শুরু করেন আজিজ খান। এরপর চিটাগুড়ের রপ্তানি ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছেন তিনি। দেশের হয়ে প্রথম চিটাগুড় রপ্তানি করেন একসময়। তারও প্রায় ২৩ বছর পর ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেন আজিজ খান।

বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস বলছে, সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে গত বছর ৪৩তম অবস্থানে আসেন আজিজ খান। তাঁর সম্পদের পরিমাণ জানানো হয় ৯৯ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ সম্পদের মূল্য প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম ডলার বিলিয়নিয়ার বা শত কোটিপতি হিসেবে স্বীকৃতি পান তিনি। ওই বছর প্রথম সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ৩৪তম অবস্থানে নাম আসে তাঁর। তখন সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ডলার। এই অর্থ বাংলাদেশে বিনিয়োগেরই হিসাব বলে জানিয়েছে সামিট।

মুহাম্মদ আজিজ খান

বিনিয়োগ দেশে দেশে

প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওএনজিসি ত্রিপুরা পাওয়ার কোম্পানির সাড়ে ২৩ শতাংশ মালিকানা নিয়েছে সামিট ইন্টারন্যাশনাল। গ্যাস ব্যবহার করে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এ কোম্পানি। সম্প্রতি অরুণাচলে আরও ১০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের কাজ পেয়েছে তারা। নেপাল ও ভুটানে বিনিয়োগের কথা ভাবছে সামিট। দেশ দুটিতে জলবিদ্যুতের ব্যাপক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চায় সামিট। নেপাল ও ভারতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাংলাদেশে সরবরাহের স্বপ্ন দেখছেন আজিজ খান।

বন্দর, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসা

আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে জাতীয় পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য একটি ভাসমান টার্মিনাল করেছে সামিট। এর বাইরে আরও দুটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। এ ছাড়া গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করেছে সরকারের কাছে। এসব প্রস্তাব এখন বিবেচনা করে দেখছে সরকার।
তথ্যপ্রযুক্তিসেবা বিস্তৃত করতে ইন্টারনেট যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে সামিট। ৪৭ হাজার কিলোমিটার ফাইবার অপটিক লাইন তৈরি করেছে কোম্পানিটি।

মুহাম্মদ আজিজ খান পরিবার
ছবি–সংগৃহীত

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাতে

বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। অবশ্য অবসরের পর ব্যবসায় যুক্ত হন তিনি। এরপর ১৯৭৩ সালে ব্যবসায় নামেন আজিজ খান। তাঁর সাত ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তিন ভাই আছেন তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়। ভাইদের মধ্যে অবশ্য ফারুক খান, ফিরোজ খান এবং ইমরান খান ব্যবসায় নেই। ফারুক খান সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্য। একসময় সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি।
আজিজ খানের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে আয়েশা আজিজ খান যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে এমবিএ। এখন সামিট ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে তিনি। বাকি দুই মেয়ের মধ্যে আদিবা আজিজ খান ব্যারিস্টার ও পিএইচডি করেছেন আইনে এবং বর্তমানে বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন। আর আজিজা আজিজ খান লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক করার পর চার্টার্ড সার্টিফায়েড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পড়া শেষ করেছেন। তাঁরা সবাই আছেন সামিটের পরিচালনা পর্ষদে। স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান একজন লোকহিতৈষী।

শখের সংগ্রহশালা

নিজের বাড়িতে শিল্পচর্চার তেমন রেওয়াজ ছিল না। তবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাড়িতে আসা–যাওয়া ছিল আজিজ খানের। তাঁর সহপাঠী ছিলেন জয়নুল আবেদিনের ছেলে মইনুল আবেদিন। এর মধ্য দিয়েই শিল্পজগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, আগ্রহ তৈরি হয়। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প সংগ্রাহকদের একজন। গড়ে তোলেন শখের সংগ্রহশালা; যেখানে আছে দেশের নামকরা সব শিল্পীর শিল্পকর্ম। শখের এই সংগ্রাহক অবশ্য মনে করেন, তাঁর নেতৃত্বে নির্মিত প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও একেকটি শিল্পকর্ম। আর যান্ত্রিক কাঠামোর এসব শিল্পকর্ম থেকে নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আলোকিত করছেন চারদিক। তিনি সামিটের গাজীপুর পাওয়ার কোম্পানিতে ‘হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্য পার্ক’ তৈরি করতে সহায়তা করেছেন, যা বাংলাদেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য পার্ক।