চাকরি ছেড়ে আখের ব্যবসায় প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিন

চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে ওই এলাকায় এবার ১০০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন তিনি। তাঁর উদ্যোগের কারণে এলাকায় অমৃত জাতের আখ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

সাহাবুদ্দিন

প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিনের বাবা কেতাবউদ্দিন আখ থেকে গুড় তৈরি করে সেই গুড় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা চুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করে বাবার সেই ব্যবসার হাল ধরেন প্রকৌশলী ছেলে। সাধারণ গুড়ের বাইরে নতুন চারটি ধরন তৈরি করেন তিনি। ছোট পাটালি, ঝোলা গুড়, পাউডার গুড় ও চকলেট আকারের গুড়—গুড়ের এই চার ধরন তৈরি করেই ব্যবসায় বাজিমাত করেন। চলতি মৌসুমে সাহাবুদ্দিনের লক্ষ্য ১০০ টন গুড় বিক্রি করা। এরই মধ্যে বিক্রি করে ফেলেছেন ৭০ টন। এপ্রিল পর্যন্ত চলে আখের মৌসুম।

 চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়নের বারোরশিয়া মাঠে সাহাবুদ্দিনের খামার। কন্টাক্ট ফার্মিংয়ে বা চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে ওই এলাকায় এবার ১০০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন তিনি। তাঁর উদ্যোগের কারণে এলাকায় অমৃত জাতের আখ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সাহাবুদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি শিবগঞ্জের খড়কপুর ইউনিয়নের মোবারকপুর গ্রামে। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজশাহীর উপশহরে। ২০১৮ সালে চুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ালেখা শেষ করেন। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। সেই চাকরি ছেড়ে যুক্ত হন বাবার ব্যবসায়। সাহাবুদ্দিনের মতে, কৃষির প্রতি ছোটবেলা থেকেই তাঁর দুর্বলতা। সেই টানেই গ্রামে ফেরেন এবং বাবার সঙ্গে আধুনিক কৃষি নিয়ে কাজ শুরু করেন।

যেভাবে শুরু

২০২০-২১ সালের কথা। নিজের জমিতে আখ চাষ হয়। তাঁরা ভেজালমুক্ত গুড় তৈরি করেন—শুনে ঢাকার পরিচিত অনেকেই এই গুড় কেনার আগ্রহ দেখান। তিনি ওই সময় আখের গুড়ের বড় পাটালি (২০ কেজির বেশি ওজন) কয়েকজন পরিচিতজনের মধ্যে হোম ডেলিভারি দেন। যাঁরা নিয়েছিলেন, খাঁটি গুড়ের স্বাদ পেয়ে তাঁরা আবার চাইলেন। এভাবে প্রথম বছর ২০০ কেজি গুড় বিক্রি করেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরিতে ঢুকে যান। চাকরির পাশাপাশি গুড়ের বেচাকেনাও চালিয়ে যান। ২০২২ সালে ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য বিপণনকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা এই গুড় নিয়ে খুব আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনেকেই মাঠপর্যায়ে এসে গুড় সংগ্রহ করেন। এভাবে চাহিদা বাড়তে থাকে। বাড়তি চাহিদার কারণে বাবার তিন বিঘা জমির আখ শেষ হওয়ার পর এলাকার পরিচিত চাষিদের দিয়ে গুড় তৈরি করান।

২০২২ সালে বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচয় হয় সাহাবুদ্দিনের। তাঁরা আখের গুড়ের একটা পাউডার ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) বের করেছেন। এটা দেখে তাঁর মনে ধরে যায়। প্রশিক্ষণ নিয়ে এই পাউডার গুড় বানানো শুরু করলেন। ২০২৩ সালে ২১ বিঘা জমি ইজারা নিলেন। সঙ্গে পৈতৃক তিন বিঘা। তাতে চাহিদা মেটানো যায় না। গত বছর থেকে নিজেরাই পাউডার গুড় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করেন। পাউডার গুড় দুই বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। ঘরে রেখে সারা বছর খাওয়া যায়। তাই ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়াও পেয়েছেন। গত বছর তিনি ৩৫ টন পাউডার গুড় বিক্রি করেন।

বেড়েছে উৎপাদন

বিএসআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে গুড় উৎপাদন ও চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ হয়েছিল ৫ হাজার ২৬৭ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে। সম্প্রতি কথা হয় স্থানীয় চাষি মো. বাদশার সঙ্গে। আগে নিজের এক বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন। এখন সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে চুক্তিতে এসে চার বিঘা জমিতে আখ চাষ করছেন। মো. বাদশা বলেন, ‘আমাদের গুড় বাজারে নিয়ে যাওয়ার কোনো ঝামেলা নাই। রং মেশানোরও দরকার হচ্ছে না। তাই ভালো দামও পাচ্ছি।’

চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামের মধু গবেষক এস এম মঈনুল আনোয়ারের পরামর্শে ও সহযোগিতায় চকলেট আকারের গুড় তৈরি করছেন সাহাবুদ্দিন। নতুন ধরনের এই গুড় ১০ থেকে ১২ গ্রাম ওজনের। একটি মুখে দিয়ে একবারেই খেয়ে নেওয়া যায়। এই গুড় বয়ামে সংরক্ষণ করা যায়। এবার একটি বহুজাতিক কোম্পানি তার কর্মচারীদের ঈদের উপহার দিতে ১ হাজার ৩০০ কেজি চকলেট আকারের গুড় কিনেছে। মধু গবেষক মঈনুল আনোয়ার জানান, ব্রিটিশ আমলে কয়েদিদের দ্রুত এনার্জি ফিরে পাওয়ার জন্য এ রকম ছোট আকারের আখের গুড় দেওয়া হতো। সেই থেকে তিনি এই ধারণাটা পেয়েছেন। এই গুড়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন সফল হলে তিনি এটির নাম দিতে চান ‘কয়েদি’ গুড়।

সাহাবুদ্দিনের খামারে সম্প্রতি আখমাড়াইয়ের আধুনিক ক্রাশিং মেশিন দেখছেন বিএসআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা
ছবি: প্রথম আলো

সাহাবুদ্দিনের খামারে একদিন

গত মাসে সাহাবুদ্দিনের খামারে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে অমৃত জাতের আখ। আখের মাঠের মধ্যে ১০টি চুলায় গুড় তৈরি করা হচ্ছে। তিনটি ক্রাশিং মেশিনে চলছে আখমাড়াইয়ের কাজ। তার মধ্যে একটি আধুনিক ক্রাশিং মেশিন। যেটির ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) বিজ্ঞানীরাও সেদিন সাহাবুদ্দিনের খামারে উপস্থিত ছিলেন। এসব বিজ্ঞানী পরিমাপ করে দেখলেন, প্রচলিত ক্রাশিং মেশিনের চেয়ে আধুনিক মেশিনে ৫ শতাংশ রস বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

গুড় নিয়ে প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিনের উদ্যোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসআরআইয়ের মহাপরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহাবুদ্দিন সম্ভাবনাময় ব্যবসায়ী। তিনি আমাদের পাউডার গুড় বাজারজাত করছেন। চকলেট আকারের গুড়টাও দেখতে সুন্দর।’ কবির উদ্দিন জানান, দেশে সাড়ে ১৬ লাখ টন চিনির ঘাটতি রয়েছে। গুড় উৎপাদন বাড়িয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এ জন্য সাহাবুদ্দিনের মতো আরও উদ্যোক্তা গড়ে ওঠা দরকার।