প্রবাসী আয় ও রপ্তানি
দুই খাতে আয় একসঙ্গে কমল
সেপ্টেম্বরে রপ্তানি ৬ শতাংশ এবং প্রবাসী আয় প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ কমেছে।বৈদেশিক মুদ্রার দুই বড় উৎসে আয় কমায় উদ্বেগ।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যখন কমতির দিকে, তখন একসঙ্গে কমল রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। বৈদেশিক মুদ্রার দুটি প্রধান উৎস থেকে আয় কমে যাওয়া নতুন করে দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল রোববার প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ও রপ্তানির হিসাব প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, গত মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা বিগত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই আয় আগের মাসের (আগস্ট) তুলনায় ২৪ শতাংশ কমেছে। গত বছরের একই মাসের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, কমার হার প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্য রপ্তানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। টানা ১৩ মাস বাড়তির ধারায় থাকার পর রপ্তানি আয় কমল।
প্রবাসী আয় যে কমেছে, তা সাময়িক। আগামী দিনগুলোতে বাড়তে পারে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দামে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রে দাম এক করে দিতে হবে।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এতে প্রবাসীরা কম পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাতে পারছেন। একই কারণে কমেছে পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ (অর্ডার)। আবার দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটেও কারখানায় উৎপাদন কমেছে।
প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দুই ধরনের দাম বেঁধে দেওয়ার কারণেও প্রবাসী আয় আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
মোটাদাগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস তিনটি—রপ্তানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, যা দেশের সক্ষমতা বাড়ায়। শ্রীলঙ্কার সংকটে পড়ার কারণ, দেশটির কাছে পণ্য আমদানি করার মতো এবং বৈদেশিক দেনা পরিশোধের মতো বৈদেশিক মুদ্রা নেই। পাকিস্তানও একই কারণে বিপাকে রয়েছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৩ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের (৩৬ বিলিয়ন) কিছু বেশি। এই অর্থ দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে। সাধারণত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা থাকলে তা সন্তোষজনক বলে গণ্য হয়।
অবশ্য দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। গত বছর আগস্টেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এতে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলার সংকট তৈরি হয়, দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। ডলারের বাড়তি দাম আবার দেশের পণ্যের দর বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিগত কিছুদিন ব্যাংকে ডলারের দাম ১০৫ টাকার আশপাশে রয়েছে। ডলার নিয়ে সংকটও কিছুটা কেটেছে। এরই মধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার খবর এল। অবশ্য পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম মনে করেন, এক মাসের ওঠানামা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধারাবাহিক তিন মাস যদি এমনটা হয়, সেটা তখন চিন্তার বিষয় হবে। মাসে মাসে ওঠানামা হতেই পারে।
প্রবাসী আয় ১৫৪ কোটি ডলার
২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ২০৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এতে মাসিক গড় আয় দাঁড়ায় ১৭৫ কোটি ডলারের মতো। তবে গত মাসে দেশে ১৫৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের মাসে অর্থাৎ আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার এসেছিল।
দেশে গত এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট শুরু হয়। এরপর ব্যাংকগুলো বেশি অর্থ ব্যয় করে ডলার সংগ্রহ শুরু করে। এতে যে ডলার ৮৬ টাকার আশপাশে ছিল, তা বেড়ে ১১৫ টাকার ওপরে উঠে যায়।
ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তা তেমন কাজ দেয়নি। গত মাসের শুরুতে মুদ্রাটির দর নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) যৌথভাবে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম এখন ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা এবং পণ্য রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দাম ৯৯ টাকা দেওয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ না করলে বিশেষ ভাতা দেওয়া হতো। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া গত মাসে ডলারের দামে বড় ওঠানামা হয়েছে। এর ফলে প্রবাসী আয় কমে গেছে। তবে এটা ঠিক হয়ে যাবে।
রপ্তানি কেন কমছে
করোনা মহামারির প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পণ্য রপ্তানি খাত। টানা ১৩ মাস পণ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এতে ছেদ পড়ল। সেপ্টেম্বরে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম।
অবশ্য সার্বিকভাবে পণ্য রপ্তানি এখনো ইতিবাচক ধারায় আছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূলত তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় সাড়ে ৭ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে গত মাসে সার্বিক পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তৈরি পোশাক ছাড়া হোম টেক্সটাইল ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাস ধরে পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশ আসার গতি কম। কয়েকটি বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে।
আবার যতটুকু ক্রয়াদেশ আছে, তার সবটুকুও গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে রপ্তানি করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। তিনি বলেন, ‘আশা করছি, ডিসেম্বরে রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরবে। কারণ, ক্রয়াদেশ আসছে। শিগগিরই বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছে সরকার।’
‘স্থিতিশীলতা জরুরি’
ব্যবসায়ীরা ডলার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে স্থিতিশীল হবে, তার অপেক্ষায় রয়েছেন। কারণ, ডলারের দামের ওপর কেনাবেচা, পণ্যের দাম, আমদানি ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা নির্ভর করে। ডলারের দাম আবার নির্ভর করে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও আমদানি পরিস্থিতির ওপর।
বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঠিক কেন প্রবাসী আয় কমে গেল, তা বলা মুশকিল।
তবে দাম বাড়াতে প্রবাসী আয় সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (রেমিট্যান্স হাউস) ডলার মজুত করতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকেও প্রবাসীদের অর্থ পাঠামো কমতে পারে। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, রেমিট্যান্স হাউস এক মাসের বেশি ডলার মজুত করতে পারবে না। তাদের বিক্রি করতেই হবে।
আহসান মনসুর বলেন, প্রবাসী আয় যে কমেছে, তা সাময়িক। আগামী দিনগুলোতে বাড়তে পারে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দামে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রে দাম এক করে দিতে হবে। তাহলে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে। আর এখন বেশি জরুরি এই বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো।