হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১০ ঘটনা

গৌতম আদানি
ফাইল ছবি

গত ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন প্রকাশের পর রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে আদানির সাম্রাজ্যে। এই কয়েক দিনে তাঁদের বাজারমূলধন কমেছে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। তা সত্ত্বেও আদানি গোষ্ঠী বলছে, তাদের প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনা অটুট আছে। ইতিমধ্যে বাজারকে আশ্বস্ত করতে তারা স্বাধীন নিরীক্ষা সংস্থা নিয়োগ দিয়েছে।

আদানি গোষ্ঠীর মুখপাত্র বলেছেন, ‘বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হলে আমাদের সব কোম্পানির পুঁজিবাজারবিষয়ক কৌশল পুনর্নির্ধারণ করা হবে। আপনাদের আশ্বস্ত করছি, আমরা বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দেব।’

হিনডেনবার্গ-আদানি কাণ্ডে যতকিছু ঘটল, তার মধ্যে ১০টি ঘটনা একবার দেখে নেওয়া যাক:

নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন, স্টক মার্কেটের নিয়ন্ত্রণকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা হোক। সরকার সেই প্রস্তাবে সায় দিয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠনে তাদের আপত্তি নেই, তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (এসইবিআই) পুরোপুরি সক্ষম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও তাদের সক্ষমতা আছে।
সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে বিশেষজ্ঞদের নাম ও প্যানেলের কার্যসীমা নিয়ে পরামর্শ চেয়েছে।

সেবি তদন্ত করছে

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আদানি–কাণ্ডে এখন পর্যন্ত সরাসরি কিছু বলেনি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বলেছেন, এই তদন্ত করবে সেবি ও রিজার্ভ ব্যাংক। হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক দিন পরেই ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নড়েচড়ে বসে। সেবি নিশ্চিত করেছে যে তারা হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছে। এ ছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশের আগে-পরে বাজারের তৎপরতাও খতিয়ে দেখবে তারা।

আরও পড়ুন

হিসাবের খাতা শক্তিশালী

হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত মাসের শেষ থেকে শেয়ারবাজারে আদানিদের নথিভুক্ত সাতটি সংস্থার মোট শেয়ারমূল্য অর্ধেক কমেছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে আদানি গোষ্ঠীর দাবি, তাদের হিসাবের খাতা (ব্যালান্স শিট) যথেষ্ট শক্তিশালী। ব্যবসা বিস্তারের পরিকল্পনা এখনো আছে। তার জন্য অর্থের সংস্থানও আছে। শেয়ারহোল্ডারদের রিটার্ন দেওয়ার বিষয়েও তারা আত্মবিশ্বাসী। এ ছাড়া করপোরেট আইন পরিপালনেও তারা তৎপর।

আদানি গোষ্ঠীর মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের সব কোম্পানির স্বাধীন পোর্টফোলিও এখনো শক্তিশালী। আমাদের খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে।’

আগেই ঋণ পরিশোধ

নির্ধারিত সময়ের আগে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। বলা হয়েছে, আগেভাগে ঋণ পরিশোধের কারণে আদানি পোর্টের ১২ শতাংশ, আদানি পোর্ট ও আদানি গ্রিনের ১ দশমিক ৪ শতাংশ ৭ শেয়ার ছাড় হবে।

অতিরিক্ত শেয়ার দেওয়ার অঙ্গীকার

এ ছাড়া ঋণের জামানত হিসেবে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও এসবিআইসিএপি ট্রাস্টি কোম্পানিকে অতিরিক্ত শেয়ার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে আদানি গোষ্ঠী।

দামি আইনি সংস্থা নিয়োগ

ওয়াচটেল, লিপটন, রোজেন অ্যান্ড কাটজ-হিনডেনবার্গের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে আমেরিকার অন্যতম ব্যয়বহুল এই আইনি সংস্থাকে নিয়োগ করেছেন আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি। আদানি গোষ্ঠীর আইনি সংস্থা ‘সিরিল অমরচাঁদ মঙ্গলদাস’ ওয়াচটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ‘সিরিল অমরচাঁদ মঙ্গলদাস’ আইনি সংস্থার প্রধান সিরিল শ্রফের মেয়ে গৌতম আদানির পূত্রবধূ।

একাধিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জটিল আইনি সমস্যা মিটিয়েছে ওয়াচটেল। সে জন্য খুব অল্প সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নাম করে নেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য দেশের নামীদামি অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান আইনি সমস্যা নিয়ে ওয়াচটেলের দ্বারস্থ হয়। ক্রমে তারা হয়ে ওঠে আমেরিকার অন্যতম ব্যয়বহুল আইনি সংস্থা।

আরও পড়ুন

শেয়ারের গুরুত্ব হ্রাস করল এমএসসিআই

হিনডেনবার্গ রিসার্চের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ ও তার জেরে তাদের শেয়ারে ধস নামার ঘটনা খতিয়ে দেখে নিজেদের সূচকে আদানিদের চার সংস্থার গুরুত্ব (ওয়েটেজ) কমিয়েছে মার্কিন সূচক প্রস্তুতকারী সংস্থা এমএসসিআই। প্রায় একই কারণে চারটি সংস্থার মূল্যায়ন (রেটিং) হ্রাস করেছে মুডিজ। এমএসসিআই জানায়, আদানি এন্টারপ্রাইজেসসহ চার সংস্থার শেয়ারের গুরুত্ব কমবে তাদের সূচকে। কারণ, সহজে সেগুলোর লেনদেন করা (ফ্রি ফ্লোট) নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ‘ফ্রি ফ্লোট’ বলতে বোঝায় কিছু যোগ্যতার ভিত্তিতে কোনো সংস্থার শেয়ার যখন সহজে কেনাবেচা যায়। এমএসসিআইর পর্যালোচনা, ওই চার কোম্পানিরই সেই যোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়।

বিনিয়োগ স্থগিত করবে টোটাল

হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পর ফরাসি সংস্থা টোটাল এনার্জি জানায়, আদানি টোটাল গ্যাসে তাদের শেয়ার রাখার বিষয়টি নতুন করে বিবেচনা করছে না তারা। প্রসঙ্গত, আদানি টোটাল গ্যাসে ফরাসি সংস্থা টোটাল এনার্জিসের ৩৭ শতাংশেরও বেশি শেয়ার রয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় তা প্রায় ২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি রুপি। তারা সরে গেলে আদানি সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত্তি আরও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

এ ছাড়া টোটাল বলেছে, গ্রিন হাইড্রোজেন খাতে তাদের যে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা ছিল, আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে স্বাধীন তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত তা স্থগিত রাখা হবে।

আরও পড়ুন

নিয়ন্ত্রক সংস্থা সজাগ

হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভারতের বিরোধী দলগুলো প্রশ্ন তুলেছিল, সেবি, রিজার্ভ ব্যাংকের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি চোখ বন্ধ করে রাখে? শেয়ারবাজার, ব্যাংক ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আরও মজবুত করার প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন খোদ সুপ্রিম কোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেন, ‘ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো পুরো বিষয়ে অবহিত। শুধু এখন নয়, তারা বরাবরই সতর্ক।’

দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাংকের পরিচালন পর্ষদের সঙ্গে বাজেটপরবর্তী বৈঠকের পর নির্মলা সীতারমণ রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসকে দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো খুবই অভিজ্ঞ। নিজ নিজ কাজে তারা দক্ষ।’

আরও পড়ুন

ঋণমান নির্ণয়কারীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কে সামগ্রিক মূল্যায়ন তারা অপরিবর্তিত রাখলেও আদানি পোর্টস ও আদানি ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে তারা—স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক। এর অর্থ হলো, ভবিষ্যতে আদানি গোষ্ঠীর মূল্যায়ন হ্রাসের আশঙ্কা। মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস বলেছে, শেয়ারদরের পতন হওয়ার কারণে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর পুঁজি সংগ্রহের সক্ষমতা কমবে। এ ছাড়া ফিচ রেটিংসের মূল্যায়নে এখনই কোনো বদল না হলেও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে তারা।

মুডিস অবশ্য শেষমেশ আদানি গ্রিন এনার্জি, আদানি গ্রিন এনার্জি রেস্ট্রিকটেড গ্রুপ, আদানি ট্রান্সমিশন ও আদানি ইলেকট্রিসিটি মুম্বাই সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক করেছে।