গোল্ডেন ভিসা নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে ইউরোপ
স্পেনের তরুণী চিকিৎসক আনা জিমেনা বারবা গত বছর মাদ্রিদ শহরের এক হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি মা–বাবার সঙ্গে শহর থেকে ৩০ মিনিটের দূরত্বে থাকতেন। তাঁর আশা ছিল, এতে বাড়িভাড়ার যে খরচ বাঁচবে, তা দিয়ে একসময় নিজের বাড়ি কিনবেন। কিন্তু এরপর নিজের গ্রামে যখন বাড়ি কেনার জন্য খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন, তখন দেখলেন, বাড়ির দাম পাঁচ লাখ ইউরোর ওপরে উঠে গেছে।
এই অর্থ কম নয়—স্পেনের গড়পড়তা বার্ষিক বেতনের প্রায় ২০ গুণ। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাড়ির এই উচ্চ মূল্যের সঙ্গে দেশটির গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচির যোগ আছে। এই কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনী ব্যক্তিদের স্পেনে বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ যাঁরা সে দেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করবেন, তাঁদের এই ভিসা দেওয়া হয়।
এক দশকে এই কর্মসূচির কল্যাণে স্পেনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে; কিন্তু এই কর্মসূচি সে দেশের মানুষের জন্য বুমেরাং হয়েছে। কারণ, বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পেনের মানুষ বিপাকে পড়েছে।
অ্যালার্জির চিকিৎসক আনা জিমেনা বারবা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘এমন কোনো বাড়ি নেই যা আমি কিনতে পারি।’ প্রতি মাসে ১০০ ঘণ্টা ওভার ওয়ার্ক বা অতিরিক্ত কাজ করেও তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশিদের কারণে আমাদের এখানে বাড়ির দাম বেড়ে গেলে বিষয়টি আমাদের জন্য অন্যায্য।’
দেশে এমন আবাসন–সংকটের মুখোমুখি হয়ে স্পেন সরকার চলতি মাসে বলেছে, তারা গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি বাতিল করবে। শুধু স্পেন নয়, ইউরোপের অন্য যেসব দেশ গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল, তারাও এই ভিসা প্রত্যাহার শুরু করেছে।
ইউরো অঞ্চল ২০১২ সালে যখন চরম ঋণসংকটে পড়ে, তখন সেখানকার ছয়টি দেশ অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা কর্মসূচি বা গোল্ডেন ভিসা চালু করে। বিশেষ করে স্পেন, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড ও গ্রিসের অবস্থা এমন ছিল যে তাদের আন্তর্জাতিক ঋণসহায়তা বা বেইল আউটের প্রয়োজন ছিল। ঋণের অর্থ ফেরত দিতে তাদের নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল। তখন তারা মুমূর্ষু আবাসন খাত চাঙা করতে বিনিয়োগকারীদের আসার সুযোগ দেয়।
এই ভিসা দিয়ে তাদের লাভও হয়েছে। আবাসন খাতে পাঁচ লাখ ইউরোর বেশি অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে স্পেন ১৪ হাজার ৫৭৬টি গোল্ডেন ভিসা দিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে সে দেশের মানুষের বাড়ি কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্র্রো সানচেজ বলেছেন, আবাসন মানুষের অধিকার; এটা ফাটকা ব্যবসা হতে পারে না। চলতি মাসে এই গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি বাতিলের ঘোষণা দেওয়ার সময় এ কথা বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, স্পেনের বড় বড় শহরে আবাসন বাজার ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছে। এখন যাঁরা বসবাস ও কাজ করছেন, তাঁদের পক্ষে শোভন আবাসন খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তাঁরা কর দিচ্ছেন।
এই গোল্ডেন ভিসার কল্যাণে ইউরোপীয় ইউনিয়নবহির্ভূত দেশের মানুষের এসব দেশে সাময়িক বসবাসের অধিকার কিনে নেওয়া সহজ হয়েছে, এমনকি সে জন্য তাঁদের সে দেশে বসবাসেরও প্রয়োজনীয়তা নেই। রাশিয়া, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীরা এখন সেখানে বিনিয়োগ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।
ব্রেক্সিটের পর ব্রিটিশ নাগরিকেরাও এই সুযোগ নিয়েছেন—গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনের মতো দেশে তাঁরা বাড়ি কিনেছেন। এমনকি মার্কিন নাগরিকেরাও এখন সেই সুযোগ নিচ্ছেন; নিজ দেশের বড় বড় শহরে কাঙ্ক্ষিত মানের জীবন যাপন করতে পারছেন না বলে তাঁরা এখন ইউরোপের দেশগুলোতে চলে যাচ্ছেন।
কিন্তু এই গোল্ডেন ভিসার কারণে আবাসন খাতের যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তার জেরে ইউরোপের দেশগুলো এই ভিসা থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ দেশগুলোকে এই কর্মসূচি অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। ইইউয়ের সতর্কবার্তা, এই ভিসা ব্যবহার করে অর্থ পাচার থেকে শুরু করে কর ফাঁকি এবং সংগঠিত অপরাধের মতো অনেক কিছুই হতে পারে।
এই ভীতি ভিত্তিহীন নয়। ২০১৮ সালে চীনের বিনিয়োগকারীরা গ্রিসে এক জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেটা হলো গ্রিসের ডেভেলপাররা বাজারমূল্যে সম্পদ কিনে চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছিলেন। এরপর ডেভেলপাররা সেই অর্থের কিছুটা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিয়েছিলেন।
২০২৩ সালে গ্রিস বিনিয়োগের সীমা দ্বিগুণ করেছে। দেশটির বেশ কিছু জনপ্রিয় স্থানে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগসীমা পাঁচ লাখ ইউরোতে উন্নীত করা হয়েছে। এরপরও গ্রিসের বিরোধী দলগুলো মনে করে, এই স্কিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কিমগুলোর অন্যতম। তারা এ সুযোগ একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে।