ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনী হিন্দুজা পরিবার কারা, কেন চার সদস্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত
গৃহকর্মীদের নির্যাতনের দায়ে যুক্তরাজ্যের ধনীতম হিন্দুজা পরিবারের চার সদস্যের কারাদণ্ড হয়েছে। এ নিয়ে হঠাৎই শুরু হয়েছে শোরগোল। দেখে নেওয়া যাক, কারা এই হিন্দুজা পরিবার; কেনই-বা তাদের এত প্রভাব–প্রতিপত্তি। কী ব্যবসাই–বা আছে তাদের।
হিন্দুজা পরিবার বহুজাতিক কোম্পানি হিন্দুজা গ্রুপের মালিক। গ্রুপটির তেল, গ্যাস, ব্যাংকিং ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যবসা রয়েছে। বিশ্বের ৩৮টি দেশে এসব খাতে হিন্দুজা পরিবারের ব্যবসা আছে। তাদের হয়ে কাজ করেন—বিশ্বজুড়ে এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন, হিন্দুজা পরিবার বিভিন্ন দেশকে যুদ্ধের সময় নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। মূলত তারা অর্থসাহায্য করে। হিন্দুজাদের ব্যবসার অন্যতম খাত ব্যাংকিং।
১৯১৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (এখন পাকিস্তানে) সিন্ধের শিকরপুর শহরে ব্যাংকিং ব্যবসা শুরু করেন প্রেমানন্দ হিন্দুজা। পরবর্তীকালে সেই ব্যবসা সরিয়ে নেন বোম্বে শহরে, যা এখন মুম্বাই নামে পরিচিত। ১৯১৯ সালে ইরানে এই ব্যাংকের আন্তর্জাতিক কার্যালয় খোলেন প্রেমানন্দ।
চার সন্তানের বাবা প্রেমানন্দ। একপর্যায়ে তাঁর সন্তানেরাও ব্যবসায় যোগ দেন। ১৯৭০-এর দশকে প্রেমচাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীচাঁদ হিন্দুজা ব্যবসার হাল ধরেন। তিনি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্দাস ইন্ড ব্যাংক। এরপর ধীরে ধীরে ব্যবসার আরও বিস্তার ঘটায় হিন্দুজা পরিবার। ব্যাংকিং ব্যবসার পাশাপাশি যানবাহন, তেল, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা বৃদ্ধি করে হিন্দুজারা।
অশোক লেল্যান্ড, হিন্দুজা হাসপাতাল, হিন্দুজা সুইস ব্যাংক, গাল্ফ অয়েল, হিন্দুজা ন্যাশনাল পাওয়ার করপোরেশন, ব্রিটিশ মেটাল করপোরেশন, হিন্দুজা কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে হিন্দুজা গোষ্ঠীর অধীন।
বর্তমানে হিন্দুজা গোষ্ঠীর কর্তা গোপীচাঁদ হিন্দুজা। ২০২৩ সালের মে মাসে শ্রীচাঁদের মৃত্যুর পরে তিনি এই গোষ্ঠীর দায়িত্ব নেন। গোপীচাঁদের পরেই আছে প্রকাশ। তারপর তাঁদের ছোট ভাই অশোক হিন্দুজা।
বর্তমানে গোপীচাঁদ হিন্দুজা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের সানডে টাইমস ম্যাগাজিন সে দেশের ধনী ব্যক্তি ও পরিবারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেই তালিকার শীর্ষে আছেন গোপীচাঁদ। ধনীদের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে আসা হিন্দুজা পরিবারের জন্য এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে গোপীচাঁদ ও তাঁর ভাই শ্রীচাঁদ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। হিন্দুজা পরিবার যুক্তরাজ্যে টানা ছয়বার ধনীদের এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
হিন্দুজা গোষ্ঠীর একটি বিলাসবহুল হোটেল নিয়ে আলোচনা আছে। সম্প্রতি এই গ্রুপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি আশ্রয় শিবিরকে হোটেলে পরিণত করেছে। সেই হোটেল তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৩ হাজার ৭০০ কোটি রুপি। সেই বিলাসবহুল হোটেলে এমন একটি বলরুম আছে, যেখানে ৬০০ জন একসঙ্গে থাকতে পারেন। এ ছাড়া আছে ৮৪ ফুট লম্বা পুল; দুই কামরার ৮৫টি ঘর, বিলাসবহুল হোটেলে স্পা, বার, ওয়াইন সেলার।
১৯৮০-র দশকে হিন্দুজা গ্রুপ দুটি বড় কোম্পানি অধিগ্রহণ করে। সেগুলো হলো—গাল্ফ অয়েল ও অশোক লেল্যান্ড।
ইতিমধ্যে হিন্দুজাদের তৃতীয় প্রজন্মও ব্যবসায় নাম লেখাতে শুরু করেছে। গোপীচাঁদের পুত্র সঞ্জয় হিন্দুজা, ধীরজ হিন্দুজা ছাড়াও প্রকাশের পুত্র অজয় হিন্দুজা ও অশোকের পুত্র সোম হিন্দুজা—প্রত্যেকেই হিন্দুজা গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির দায়িত্বে আছেন। সারা পৃথিবীতেই এই পরিবারের ব্যবসা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। কিন্তু গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে সেই পরিবারের চার সদস্যের কারাদণ্ড হয়েছে।
কেন কারাদণ্ড
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় হিন্দুজা পরিবারের বাসগৃহে ভারত থেকে নিয়ে আসা গৃহকর্মীদের নির্যাতন ও অবৈধভাবে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে সুইজারল্যান্ডের আদালত এই চার সদস্যের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।
প্রকাশ ও কমল হিন্দুজা এবং তাঁদের ছেলে অজয় ও পুত্রবধূ নম্রতাকে গৃহকর্মীদের নির্যাতন ও অবৈধভাবে চাকরিতে নেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ ও কমল হিন্দুজাকে সাড়ে চার বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত; অজয় ও নম্রতাকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, বিশ্বের অন্যতম ধনী এই পরিবার আদি নিবাস ভারত থেকে সুইজারল্যান্ডে কর্মচারী নিয়ে আসত। কিন্তু এই কর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হতো। গৃহকর্মীদের দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করার বিনিময়ে মাত্র ৮ ডলার বেতন দিত হিন্দুজারা। সুইস আইন অনুযায়ী, এই পরিমাণ সময় কাজ করার জন্য গৃহকর্মীদের যতটুকু মজুরি পাওয়ার কথা, এটা তার ১০ ভাগের ১ ভাগ। সেই সঙ্গে কর্মীদের পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়ার অভিযোগও ছিল।
আদালতের শুনানিতে কর্মীদের কৌঁসুলিরা অভিযোগ করেন, পোষা কুকুরের জন্য হিন্দুজা পরিবার যত অর্থ ব্যয় করে, গৃহকর্মীদের জন্য তার চেয়েও কম করে। পরিবারটি কুকুরের জন্য বছরে প্রায় ১০ হাজার ডলার খরচ করে বলে তাঁদের দাবি। কর্মীদের আরও অভিযোগ, তাঁদের একরকম বাড়ি থেকে বেরই হতে দেওয়া হতো না।
শুধু এসব নয়, হিন্দুজা পরিবারের বিরুদ্ধে মানব পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল; সেই অভিযোগ থেকে অবশ্য তাঁদের খালাস দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে হিন্দুজা পরিবারের আইনজীবীদের দাবি, কর্মীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেয় হিন্দুজা পরিবার।
তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়নি, বা আটকে রাখা হয়নি। তাঁদের দাবি, এই কর্মীরা যেকোনো সময় ভিলা ছেড়ে বেরোতে পারতেন।
আইনজীবীরা দাবি করেন, ‘উন্নত জীবন দেওয়ার জন্য’ কর্মীরা ‘হিন্দুজাদের প্রতি কৃতজ্ঞ’।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সুইজারল্যান্ডের ধনী ব্যক্তিদের কেন্দ্র জেনেভায় গৃহকর্মীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণের অভিযোগ আগেও এসেছে। গত বছর ফিলিপাইনের চারজন গৃহকর্মী জাতিসংঘে জেনেভার এক কূটনৈতিক মিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, ওই মিশন কয়েক বছর তাঁদের বেতন দেয়নি।
মামলায় হিন্দুজা পরিবারের বাইরেরও একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি আছেন। হিন্দুজা পরিবারের ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যবস্থাপক নজিব জিয়াজির ১৮ মাসের স্থগিত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ১৮ মাস প্রোবেশনেও কাটাতে হবে।