অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে যা বলছে বৈশ্বিক গণমাধ্যম
কোভিডের সময় থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমতে শুরু করে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলার–সংকটের কারণে অর্থনীতি আরেক দফা ধাক্কা খায়। এই বাস্তবতায় ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর অর্থনীতি যখন স্থিতিশীল হতে শুরু করে, তখন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হলো।
দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে এখন কী করা দরকার, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিচ্ছে। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনার পতনের কারণসমূহও তুলে ধরছে গণমাধ্যমগুলো। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হিসেবে তরুণদের বেকারত্বকেই চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া কাঠামোগত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথাও জানিয়েছে তারা। নতুন সরকারের কী করণীয়, সে বিষয়েও বিদেশি গণমাধ্যমগুলো মোটামুটি একই সুরে কথা বলেছে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তরুণদের এই অভ্যুত্থানের মূল কারণ হলো বেকারত্ব। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করছেন; যদিও শিক্ষার নিম্নমান ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে তরুণদের কর্মক্ষমতা কম। এই বাস্তবতায় তরুণেরা নিজেদের বঞ্চিত ও প্রতারিত বোধ করতেন; সেখান থেকেই অভ্যুত্থানের প্রেরণা।
বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বয়স ৩০-এর নিচে। বিষয়টি এত দিন জনসংখ্যাগত সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু বিশ্লেষকেরা এখন বলছেন, উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান না হলে এই সুবিধা অভিশাপে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এই বাস্তবতায় দেশের তরুণদের এই অভ্যুত্থান বলে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন।
অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান সেভাবে হয়নি। তাঁদের ভাষ্যমতে, এটা হলো কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। তাই বিদ্যমান বাস্তবতায় মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সবচেয়ে বড় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তা না হলে বঞ্চনা ও প্রতারিত হওয়ার বোধ তরুণদের বুকের মধ্যে আগের মতোই ধিকিধিকি জ্বলবে।
ডয়চে ভেলে বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। দেড় বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বলা যায়, দুই বছর ধরে দেশের মানুষের ক্ষোভের মূল কারণ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কলকারখানা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। ডয়চে ভেলে মনে করছে, এই মুহূর্তে ইউনূস সরকারের মূল লক্ষ্য হলো, অর্থনীতি পুনরায় পুরোপুরি সচল করা। তারা বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তৈরি পোশাকের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। তবে অনতিবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে এই খাতে দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়বে না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অর্থনীতি পুনরায় সচল করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিরসনে কাঠামোগত সংস্কারে হাত দিতে হবে। যেমন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দূরীকরণ, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, কর ও শুল্কনীতির সংস্কার ইত্যাদি। এসব সমস্যার সমাধানে সরকারের উচিত হবে একাধিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা। এসব শুরু করতে দেরি করা যাবে না, সেটাই হলো বড় চ্যালেঞ্জ।
ইকোনমিক টাইমস বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। এই সময়ে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬ সালের পর মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এরপর ২০২০ সালে শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারি। ওই সময় রপ্তানি কমে যায়।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরেকবার ধাক্কা খায় বাংলাদেশের অর্থনীতি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কষ্ট বেড়েছে। দেশীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মার্কিন ডলারের নিরিখে জনগণের মাথাপিছু আয় কমে গেছে। সেই সঙ্গে উচ্চ বেকারত্বের কারণে তরুণদের মধ্যে যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে, তা-ই শেষমেশ হাসিনার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করে ইকোনমিক টাইমস।
ইকোনমিক টাইমস আরও বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। গত ১৫ বছরে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হলেও এ দেশের অর্থনীতির বহুমুখীকরণ হয়নি।
মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো চায়না প্লাস ওয়ান কৌশল গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ তারা চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে আল–জাজিরা জানায়, বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা ভিন্ন চিন্তা করতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার আগে দরকার হলো আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার।
কর্মসংস্থানের বিষয়টি আল-জাজিরাও উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। গত দুই দশকে এই দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বৈষম্যও বেড়েছে অনেক বেশি। এ ছাড়া ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ কোনো কাজে, প্রশিক্ষণে বা শিক্ষায় নেই।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছে। মূলত অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের দুর্বলতার কারণে তারা ঋণমান অবনমন করে।
এসঅ্যান্ডপি আরও বলেছে, গত জুন মাসের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই মাসে যে সহিংসতা দেখা দেয়, তার রাশ টানতে সরকার কারফিউ জারি করে ইন্টারনেট বন্ধ রাখে। এর প্রভাবে দেশের রিজার্ভ কমতে পারে বলে মনে করে এসঅ্যান্ডপি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রপ্তানি আয় কমতে পারে।
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।