মার্কিন নির্বাচনে এফটিসি–প্রধান লীনা খান কেন আলোচনায়
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে যে সরকারি সংস্থা, সেই ফেডারেল ট্রেড কমিশনের প্রধান লীনা খানকে সরিয়ে দিতে দেনদরবার করছেন বড় বড় অনেক মার্কিন ব্যবসায়ী। তাঁদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির চাঁদাদাতা দুই শতকোটিপতি—ব্যারি ডিলার ও রিড হফম্যান। তাঁরা আশা করছেন, কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লীনা খানকে আর পদে রাখবেন না।
রয়টার্স জানিয়েছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বাজার প্রতিযোগিতা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে লীনা খানকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাইডেনের এই পছন্দকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছেন ডিলার ও হফম্যান। তাঁদের মধ্যে ব্যারি ডিলার ভ্রমণবিষয়ক সাইট এক্সপেডিয়ার চেয়ারম্যান। আর লিঙ্কডইনের সহপ্রতিষ্ঠা হলেন রিড হফম্যান।
বাইডেন প্রশাসন অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছে প্রতিযোগিতাবিষয়ক আইন ব্যবহার করে বাজারে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে। এর মাধ্যমে উচ্চমূল্য আর কম আয়ের যে সমস্যা, তারও কিছুটা সমাধান করতে চান প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সম্প্রতি ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) প্রতিযোগিতাবিহীন চুক্তি নিষিদ্ধ করেছে। এটি করা হয়েছে লীনা খানের তত্ত্বাবধানে।
বড় ব্যবসার বিষয়ে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে লীনা খানের ওপর অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান রীতিমতো ক্ষিপ্ত। কিন্তু আবার এ কারণে তাঁর অনেক ভক্তও রয়েছে। তাঁদের একজন জেডি ভ্যান্স। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের রানিংমেট, অর্থাৎ জিতলে তিনিই হবেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
এ পরিস্থিতিতে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেন, এমন অনেক ধনী ব্যবসায়ী প্রকাশ্যে বলছেন যে তাঁরা সম্ভাব্য হ্যারিস প্রশাসনে লীনা খানকে দেখতে চান না।
ব্লুমবার্গের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যারি ডিলার বলেন, আইন যতটা অনুমোদন দেয়, তিনি ঠিক সেই পরিমাণ অর্থ কমলা হ্যারিসের প্রচারণার জন্য দেবেন। অন্যদিকে সিএনবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, লীনা খানকে সরাতে তিনি হ্যারিসের কাছে সুপারিশ করবেন। কারণ, একটি ব্যবসা দক্ষভাবে বড় হতে যা করতে হয়, লীনা খান তার ‘প্রায় সব কিছুর’ বিপক্ষে।
লীনা খানের অধীনে এফটিসি ব্যবসা একীভূতকরণ ঠেকানোর বিষয়ে একধরনের পরিচিতি অর্জন করেছে। তবে বাস্তবে এই সংস্থা বছরে ২ শতাংশেরও কম চুক্তি পর্যালোচনা করে, আর প্রতিরোধ করে ১ শতাংশের কম চুক্তি।
যেসব চুক্তি বন্ধ করতে এফটিসি মামলা করেছিল, সেগুলোর মধ্যে ছিল নিত্যপণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ক্রোগার ও অ্যালবার্টসন। চুক্তিগুলো বন্ধ করার ক্ষেত্রে এফটিসি শুধু ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়ের কথা ভাবেনি, বরং তা শ্রমিকদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ও আদালতে তুলে ধরে।
এফটিসির মুখপাত্র ডগলাস ফেরার বলেন, ‘ লীনা খান বাইডেন প্রশাসনে কাজ করতে পেরে গর্বিত। এই কাজের মাধ্যমে তিনি ভোক্তা, শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের বেআইন আচরণ ও করপোরেট অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।’
বৃহস্পতিবার সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রিড হফম্যান বলেন, তিনি আশা করছেন, কমলা হ্যারিস লীনা খানকে সরিয়ে দেবেন। তাঁর মতে, এফটিসির চেয়ারপারসন ‘এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আমেরিকাকে সাহায্য করছেন না’। হফম্যান ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য চাঁদা তোলে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭০ লাখ ডলার দিয়েছেন।
রিড হফম্যান সফটওয়্যার কোম্পানি মাইক্রোসফটের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য। ২০১৬ সালে মাইক্রোসফট ২ হাজার ৬২০ কোটি ডলারে লিঙ্কডইন কিনে নেয়। মাইক্রোসফট গেমস কোম্পানি অ্যাক্টিভিশন ব্লিজার্ড অধিগ্রহণের চেষ্টা করার পর এফটিসি বিশাল এই সফটওয়্যার কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।
তবে গুরুত্বপূর্ণ ডেমোক্রেটিক সিনেটরদের কেউ কেউ লীনা খানের সমর্থনে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বার্নি স্যান্ডারস ও এলিজাবেথ ওয়ারেন। শুক্রবার এলিজাবেথ ওয়ারেন বলেন, লীনা খানের কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল প্রকাশিত জিডিপি পরিসংখ্যানে অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার পেছনে মূল কারণ এটিই।’
কে এই লীনা খান
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের মার্চে লীনা খানকে এফটিসির একজন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। সিনেটে শুনানির পর জুন মাসে তাঁর মনোনয়ন নিশ্চিত করা হয়। তিনি দুই দল থেকেই সমর্থন পান। এরপর বাইডেন তাঁকে এফটিসির চেয়ারপারসন হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি হলেন এফটিসির তৃতীয় এশিয়ান–আমেরিকান প্রধান।
লীনা খানের জন্ম লন্ডনে। তাঁর মা–বাবা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। তাঁর বয়স যখন ১১ বছর, তখন পরিবারটি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। সেখানেই লীনা খানের পড়াশোনা।
২০১৭ সালে ইয়েল ল স্কুলে লীনা খান যখন থার্ড ইয়ারে তখন তিনি ‘অ্যামাজনস অ্যান্টিট্রাস্ট প্যারাডক্স’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ইয়েল ল জার্নালে ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন আইন ও ব্যবসা অঙ্গনে এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়। নিউইয়র্ক টাইমস ওই নিবন্ধকে বর্ণনা করে ‘দশকের পর দশকব্যাপী বহাল থাকা একচেটিয়া আইনের পুনর্লিখন’ হিসেবে।
ওই নিবন্ধে লীনা খান যুক্তি দেখান, বর্তমানে প্রতিযোগিতাবিষয়ক যে আইন আছে তার মূল লক্ষ্য ভোক্তামূল্য কমিয়ে রাখা। কিন্তু অ্যামাজনের মতো প্ল্যাটফর্মভিত্তিক যে ব্যবসা মডেল রয়েছে, তাদের প্রতিযোগিতাবিষয়ক নিয়মনকানুন মেনে চলতে এ আইন কাজ করছে না। মূলত লীনা খান বিশ্বাস করেন, বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি করার মার্কিন ব্যবস্থা কাজ করছে না।
কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে বাজার
গার্ডিয়ান জানায়, সুপারমার্কেট ক্রোগার ২ হাজার ৪৬০ কোটি ডলারের বিনিময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান অ্যালবার্টসন কেনার চুক্তি করেছিল। এই চুক্তির বাস্তবায়ন বন্ধ করতে এফটিসি গত সপ্তাহে মামলা করে। এফটিসি সতর্ক করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই একীভূতকরণ বাস্তবায়িত হলে লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন কেনাকাটার খরচ বেড়ে যাবে।
এফটিসির হিসাবে, একীভূতকরণের ফলে ক্রোগার ও অ্যালবার্টসনের মোট দোকানের সংখ্যা হতো পাঁচ হাজার। আর ৪৮টি রাজ্যে মোট কর্মীর সংখ্যা দাঁড়াত সাত লাখে। এফটিসি জানায়, চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন নির্বাহী জানিয়েছেন, একীভূতকরণ ‘মূলত একটি একচেটিয়া ব্যবসা’ তৈরির পথ খুলে দিত।
যুক্তরাষ্ট্রে সবকিছু কেন্দ্রীভূত হওয়ার একটি উদাহরণ হলো পণ্যের বাজার। ৩৩ কোটি মানুষের এ দেশটিতে মাত্র ছয়টি কোম্পানি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।