মুদ্রা ভাসমান করে অবশেষে বেদনাদায়ক যাত্রা শুরু করেছে ইথিওপিয়া
ইথিওপিয়ার রাজধানী শহর আদ্দিস আবাবায় একটি ছোট ফ্যাশন হাউস চালান মেদানিত ওলডেজেব্রিয়েল। গত দুই মাসের মধ্যে তাঁর দোকানে পোশাকের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এর ফলে ক্রেতারা আর আপাতত তাঁর দোকানমুখী হচ্ছেন না।
আদ্দিস আবাবা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরের জমজমাট মেরকাটো মার্কেটে মেদানিত ওলডেজেব্রিয়েলের দোকান। তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পোশাক আমদানি করেন তিনি। এখন তাঁর মন খারাপ, কারণ ‘ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না’।
গত ৩০ জুলাই ইথিওপিয়া বেদনাদায়ক এক যাত্রা শুরু করেছে। দেশটি তার মুদ্রাকে ভাসমান করেছে, অর্থাৎ ‘বির’ এখন ডলারের বিপরীতে অবাধে লেনদেন করা যাবে। কিন্তু রাতারাতি বিরের মূল্যমান এক–তৃতীয়াংশ কমে গেছে। এর পর থেকে মুদ্রাটির পতন অব্যাহত আছে। ১ ডলারে এখন ১১২ বির পাওয়া যাচ্ছে। মুদ্রা ভাসমান করার আগে পাওয়া যেত ৫৫ বির।
সরকারের হাতে বিকল্প খুব কমই ছিল। গত বছর ফুল, চা আর কফির মতো পণ্য রপ্তানি করে দেশটির মোট আয় ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার। সেই তুলনায় আমদানির পেছনে ইথিওপিয়াকে খরচ করতে হয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলার। খাদ্য, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল দেশটির মূল আমদানিপণ্য।
বিনিময় হারে সংস্কারের আগে ইথিওপিয়ার হাতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ছিল, তা দিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের আমদানি দায় মেটানো যেত। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা অনেক দিন ধরেই যুক্তি দিচ্ছিলেন যে ডলারের সঙ্গে বির পেগ করে রাখার বিষয়টি টেকসই নয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইথিওপিয়াকে ৩৪০ কোটি ডলার দেওয়ার একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আর বিশ্বব্যাংক ১৫০ কোটি ডলার অর্থায়ন করার পরিকল্পনা করছে। তবে দুটো পরিকল্পনাই স্থগিত রাখা হয়েছিল। কারণ, তাদের চাওয়া ইথিওপিয়া আর দেরি না করে তার মুদ্রাকে স্বাধীনভাবে বিনিময়যোগ্য বলে ঘোষণা করুক।
দেশটির এক–তৃতীয়াংশ মানুষ প্রতিদিন ২ দশমিক ১৫ ডলারের কম আয় করেন এবং দারিদ্যসীমার নিচে বাস করেন। এসব সাধারণ মানুষের ওপর মুদ্রা ভাসমান করার বিষয়টি খুবই কঠোরভাবে আঘাত হেনেছে। মেরকাটো বাজারে এক ক্রেতা তাঁর বাচ্চাদের জন্য কয়েকটি টমেটো ও কিছু বই কিনতে এসেছিলেন। তাঁর মতে, জিনিসপত্রের দাম এক–তৃতীয়াংশ বেড়েছে।
এই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার পরিবারে এমন সদস্য আছে, যারা বিদেশে থাকে এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়। এটা ছাড়া আমরা চলতেই পারতাম না।’
কষ্টকর জীবন
১২ কোটি মানুষের দেশ ইথিওপিয়ায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৩০ শতাংশ। কোভিড–১৯, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, প্রচণ্ড খরা এবং দেশটির টিগ্রে এলাকায় সংঘাত—সবকিছুর প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতির হিসাবে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের অর্থনীতিবিদ টিওড্রস মেকোনেন জেব্রেওয়ল্ডে স্বীকার করেন যে মুদ্রা ভাসমান করার পদক্ষেপ ‘স্বল্প মেয়াদে এমন একটি পিল, যা গলা দিয়ে নামানো খুব কঠিন’। তবে তাঁর মতে, এটাই ছিল সরকারের সামনে একমাত্র বিকল্প।
মুদ্রার বিনিময় হারের এই সংস্কারের ফলে ইথিওপিয়ার রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। এর ফলে নতুন যেসব আইনকানুন হবে, তার কারণে আরও বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সহজে ডলার কিনতে পারবে। আগে মাত্র কয়েকটি বিশেষ খাত ডলার কিনতে পারত।
আগের বিধিনিষেধের কারণে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পূর্ণ সক্ষমতায় চলত না। এসব প্রতিষ্ঠান কাচামাল ও যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে পারত না। টিওড্রস জেব্রেওয়ল্ডে বলেন, কোম্পানিগুলো এখন আগের চেয়ে সহজে বিদেশি মুদ্রা পাবে বলে কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর ফলে তারা উৎপাদনসক্ষমতা বাড়াতে পারবে। এতে উৎপাদন বাড়বে।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ মুদ্রার সংস্কারকে এই বলে সমর্থন করেছেন যে এর ফলে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি দূর হবে এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি হওয়ার পথের বাধা সরে যাবে।
মুদ্রা ভাসমান করার আগে আনুষ্ঠানিক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের মধ্যে বিশাল পার্থক্য ছিল। আনুষ্ঠানিক দামের দ্বিগুণ দামে কালো বাজার থেকে ডলার কিনতে হতো। মুদ্রা ভাসমান করার ফলে চোরাচালান কমবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ টিওড্রস জেব্রেওয়ল্ডে। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ব্যবসায়ই এখন বৈধ পথে হবে।
কিন্তু ইথিওপিয়ায় বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক সমস্যা চলছে। বেড়ে চলছে নিত্যপণ্যের দাম। এর ফলে মেরকাটো বাজারে বাচ্চাদের জন্য টমেটো ও বই কিনতে আসা ক্রেতা ইতিমধ্যেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর কথায়, ‘পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে, এমন কোনো আশা আমি দেখছি না।’