প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সম্পদ হস্তান্তর হয়, এটাই আবহমানকালের রীতি। তবে সময়ের সঙ্গে সম্পদ বদলের এ ধরন বদলাচ্ছে। আগে যেভাবে সম্পদ হস্তান্তর হতো এবং তার যে উদ্দেশ্য, উভয় ক্ষেত্রেই এখন পরিবর্তন আসছে। বহুজাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আলট্রাটার এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে এই পরিবর্তন আসছে। গত মে মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। আলট্রাটারই প্রতিষ্ঠান ওয়েলএক্সে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগামী ১০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনী মানুষ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হস্তান্তর করবেন। এ সময় বিশ্বের প্রায় ১২ লাখ ধনী ৩১ ট্রিলিয়ন বা ৩১ লাখ কোটি ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ হস্তান্তর করবেন। এই অঙ্ক যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির চেয়ে বেশি। পাশাপাশি বিশ্বের মহিরুহ প্রযুক্তি কোম্পানি মাইক্রোসফটের বাজার মূলধনের ১০ গুণ।
তবে সব শ্রেণির ধনী যে একই হারে সম্পদ হস্তান্তর করবেন, তা নয়। আগামী ১০ বছরে ৩১ ট্রিলিয়ন বা ৩১ লাখ কোটি ডলার সম্পদের প্রায় অর্ধেক হস্তান্তর করবেন সেই ব্যক্তিরা, যাঁদের সম্পদমূল্য ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ অতিধনী ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। যেসব মানুষের সম্পদমূল্য ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ডলার, এই শ্রেণির ৮৭ শতাংশ ধনী সম্পদ হস্তান্তর করবেন। বাকি যে ১৩ শতাংশ অতিধনী, যাঁদের সম্পদমূল্য ৩ কোটি ডলারের বেশি, সেই শ্রেণির ধনীরা মোট সম্পদের ৬৪ শতাংশ হস্তান্তর করবেন।
সব অঞ্চলের ধনীরা যে একইভাবে সম্পদ হস্তান্তর করবেন, তা-ও নয়। ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ধনীর যত সম্পদ হস্তান্তর করবেন, তার ৭১ শতাংশই হস্তান্তর করবেন উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ধনীরা। উত্তর আমেরিকার যে ধনীদের সম্পদমূল্য ৫০ লাখ ডলারের বেশি, তাঁরা হস্তান্তর করবেন ১৪ লাখ কোটি ডলার। তাঁদের হস্তান্তরিত এ সম্পদ আগামী ১০ বছরে হস্তান্তরযোগ্য সম্পদের প্রায় ৪৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের হিস্যা ২২ শতাংশ বা ৭ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। ইউরোপের চেয়ে এশিয়ায় ধনী মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও মোট সম্পদের মাত্র ৫ শতাংশ তাঁরা হস্তান্তর করবেন। কারণ, এশিয়ার ধনীদের বয়স ইউরোপের ধনীদের তুলনায় কম।
বিশ্বজুড়ে অতিধনীরা যে সম্পদ হস্তান্তর করবেন, তা মূলত তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেই হস্তান্তরিত হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক অংশীদার ও কল্যাণকামী সংগঠনের কাছেও এই সম্পদের একাংশ হস্তান্তরিত হবে। সম্পদগ্রহীতাদের তালিকায় আরও আছে ধনীদের ভাইবোন, নাতি, বন্ধু ও সহযোগী। যাঁরা এই সুবিধা পাবেন তাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো, এরা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে আগের প্রজন্মের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। দান-খয়রাত করার ক্ষেত্র নির্বাচনে আগের প্রজন্মের দাতাদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পছন্দের অবশ্য বিশেষ পার্থক্য নেই—এই প্রজন্মও শিক্ষা, শিল্পকলা ও সামাজিক কল্যাণে ব্যয় করতে আগ্রহী। চোখে পড়ার মতো পার্থক্য হলো, এই তিনটি উদ্দেশ্যের প্রতি নতুন প্রজন্মের অঙ্গীকার বেশি; এ ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণও বেশি।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আলট্রাটার ক্লায়েন্ট সাকসেস ব্যবস্থাপক ডি’ আরসি ফেলোনা বলেন, তরুণ প্রজন্ম বদান্যতা ও ফাউন্ডেশনের বিষয়ে আগ্রহী। এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা বেশি বেশি দান-খয়রাত করেন; কিন্তু এসব লক্ষ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের একাত্মতা বেশি। এই প্রজন্ম সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে জড়িত হতে চান; সেই সঙ্গে সামাজিক কাজের প্রভাবও দেখতে চান তাঁরা।
আলট্রাটার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও উত্তরাধিকারীদের সামাজিক ও জলবায়ুগত আগ্রহের মধ্য দিয়ে আগের প্রজন্মের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। ফলে পারিবারিক সম্পদ বিতরণ ও ভবিষ্যৎ মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হতে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্পদের মালিকানা নিয়ে আইনি জটিলতা তৈরিরও আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে অস্থির ভূরাজনীতির কারণে গত কয়েক দশকে মানুষ সম্পদ স্থানান্তরে আগ্রহী হয়েছে। এতে সুবিধা হয়েছে; কর ফাঁকি দেওয়া গেছে; কিন্তু একই সঙ্গে তা ঝুঁকির কারণও হয়েছে। এসব কারণে সম্পদ হস্তান্তরে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি হয়ে উঠেছে।
পারিবারিক সম্পদ হস্তান্তরের মানদণ্ড একরকম থাকছে না; পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ধাঁচ ও জটিল ভূরাজনৈতিক পরিবেশ এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে। বিশ্বের ধনী পরিবারগুলোর সদস্যরা এখন আর এক দেশে থাকেন না; বিশ্বায়নের কল্যাণে এসব পরিবারের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ফলে উত্তরাধিকার নির্বাচন ও সম্পদের বণ্টন ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। সেই সঙ্গে সম্পদের মালিকানা ও সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধানও আমলযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একসময় পরিবারপ্রধানের মৃত্যুর পর সম্পদ হস্তান্তরের বিষয়টি সামনে আসত। কিন্তু এখন পরিবারপ্রধানের জীবদ্দশায় সম্পদের বড় একটি অংশ হস্তান্তর হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাস্তব, লজিস্টিক ও কর-পরিকল্পনাজনিত বিষয়ে এটি হচ্ছে। তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা তৈরি ও বিনিয়োগের নতুন নতুন সম্ভাবনা উন্মোচনের কারণে অনেক পরিবারেই এখন কর্তার মৃত্যুর আগে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সম্পদ হস্তান্তরের প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধিও বিবেচ্য বিষয়। একসময় যেমন তাঁদের কেবল জানিয়ে দেওয়া হতো, কে কোন সম্পদ পেল; সেই দিন বিগত হতে শুরু করেছে। এখন তাঁদের সম্পদ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত কেন ও কীভাবে নেওয়া হলো, তা বোঝাতে হয়।
এবার দেখা যাক, কোন প্রজন্মের মানুষ সম্পদ হস্তান্তর থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। গবেষণা বলছে, জেনারেশন এক্সের (জন্ম ১৯৬৫-১৯৮০) মানুষেরা মূলত এই সম্পদ হস্তান্তর থেকে সবচেয়ে লাভবান হবেন। তাঁদের বয়স ৪০-এর ওপরে। এখন মিলেনিয়াল (জন্ম ১৯৮১-৯৬) ও জেন-জি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়; এই প্রজন্ম মূলত পিতামহদের কাছ থেকে সম্পদ পাবেন। গবেষণা বলছে, ধনী পিতার কাছ থেকে যে পরিমাণ সম্পদ পাওয়া সম্ভব, পিতামহের কাছ থেকে অতটা সম্পদ পাওয়া যাবে না।
যুগে যুগে এই সম্পদ ও অর্থ নিয়েই মানুষের মধ্যে বিবাদ হয়েছে। সে জন্যই বলা হয়, অর্থই অনর্থের মূল। পরিবারের মূল্যবোধ রক্ষা করে মোটামুটি ন্যায্যতার সঙ্গে সম্পদ হস্তান্তর করা তাই খুব সহজ কাজ নয়। সে জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা করে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করায় জোর দেওয়া হয়েছে আলট্রাটার প্রতিবেদনে।