কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কেন জরুরি
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল প্রায় সময় একটি মৌলিক বিষয় মনে করিয়ে দেন। সেটা হলো, বাজারে পণ্যের দাম স্থিতিশীল না থাকলে অর্থনীতি কারও জন্য ঠিকঠাক কাজ করে না। টাকার মূল্যমান হারানোর ভীতি না থাকলে উদ্যোক্তারা নির্ভারচিত্তে বিনিয়োগ করতে পারেন, তখন কর্মসংস্থানেও গতি আসে।
গত চার বছরে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতার বিষয়টি একাধিকবার পরীক্ষার মুখে পড়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক ব্লগপোস্টে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ববাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর জেরে পণ্যমূল্য বাড়ে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার সংকট মোকাবিলায় জনগণ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণে প্রণোদনা দিয়েছে। মানুষের হাতে অর্থ আসায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়; এর জেরে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি হয়।
এরপর ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভাঙন ধরে এবং পণ্য ও সেবার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়। এটি যে খুব দ্রুত নিম্নমুখী হবে, আপাতত তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়—এমন নজির ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়। তর্কযোগ্যভাবে একটি কার্যকর মুদ্রানীতি নিশ্চিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা; উদীয়মান দেশগুলোর সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
উদীয়মান দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা আসে ১৯৭০-এর দশকে। সে সময় সৌদি আরব ও কুয়েতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেল বিক্রির অর্থে ফুলেফেঁপে ওঠে। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত তৈরি হয়। সেই অর্থ তারা পশ্চিমা ব্যাংকগুলোতে জমা রাখে। ব্যাংকগুলো তখন উদীয়মান দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণে ঋণ দেয়। তবে ১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগে মুদ্রানীতির রাশ টেনে ধরা হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি কমে যায়।
এরপর ১৯৮০-এর দশকে উদীয়মান দেশগুলোতে বারবার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশে বিদেশি ঋণপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন তাদের পুঁজিবাজারের অবস্থা ভালো না থাকায় সরকারের বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়। একদিকে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়া এবং আপর দিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় মানুষ কষ্টের মধ্যে পড়ে যায়। এই দশকের নাম দেওয়া হয়েছে দ্য লস্ট ডিকেড বা হারিয়ে যাওয়া দশক।
১৯৯০-এর দশকে মেক্সিকো, পেরু ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। শুরু হয় অর্থনৈতিক সংস্কারের কঠিন এক পথ। এই সংস্কার কার্যক্রমের মূলে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এতে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ‘মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা’ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়ন।
এরপর দেখা গেল, ধীরে হলেও এসব দেশের অর্থনৈতিক ও আর্থিক পরিস্থিতিতে পুরোদস্তুর পরিবর্তন এসেছে। গত দুই বছরে যে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ল, তখনো দেখা গেল, মুদ্রানীতি সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উদীয়মান দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে। ব্রাজিল, হাঙ্গেরি ও চিলির মতো দেশগুলো ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগেই মুদ্রানীতির রাশ টানে এবং সময়মতো আলগাও করে।
এর বিপরীতে দেখা গেল, যেসব দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে, তাদের অবস্থা ওই সব দেশের তুলনায় অনেক খারাপ। একই সময়ে আর্জেন্টিনা ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশ অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতায় জেরবার হয়েছে। এ দেশগুলোর সরকার আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়ে অর্থ ছাপিয়েছে, যার ফল তারা হাতেনাতে পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতায় রাজনৈতিক প্রভাব
সম্প্রতি দেখা গেছে, ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিক নেতাদের কল্যাণে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে। ২০২১ সাল থেকে তারা বাড়তি স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং তার কল্যাণে মূল্যস্ফীতির চাপ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে। কিন্তু সম্প্রতি ব্রাজিল সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নীতি সুদহার আরও কমানোর চাপ দিচ্ছে। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার, অর্থনীতিতে আরও গতি আনতে চায় তারা।
শুধু উদীয়মান দেশ নয়, উন্নত দেশেও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হবে। তার আগে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার প্রাণ হচ্ছে মার্কিন ডলার ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থা। ব্লগপোস্টে বলা হয়েছে, এ ব্যবস্থায় মানুষের বিশ্বাসে চিড় ধরলে বিশ্বজুড়ে তার বেদনা অনুভূত হবে।