বিশাল কোম্পানির মালিক হয়েও রতন টাটা কেন বিলিয়নিয়ারের তালিকায় ছিলেন না
অসম্ভব বিনয়ী একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন রতন টাটা। একসময় ৩০টির বেশি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে, যাঁর ব্যবসা ছিল বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে। পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশে ছড়িয়ে ছিল টাটা গ্রুপের ব্যবসা। একজন ‘বিজনেস টাইকুন’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও রতন টাটা কখনো কোনো বিলিয়নিয়ারের তালিকায় নাম তোলেননি।
ভারতে এখন বেশ কজন বিলিয়নিয়ার রয়েছেন। এই সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। গৌতম আদানি কিংবা মুকেশ আম্বানি শীর্ষ বিলিয়নিয়ারের তালিকায় রয়েছেন। কিছুদিন আগে মুকেশ আম্বানির এক ছেলের বিয়ের জাঁকজমক পুরো বিশ্বে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছিল। সেই তুলনায় রতন টাটা কিংবা টাটা পরিবারের সদস্যরা বেশ আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন।
রতন টাটা প্রায় ছয় দশক ভারতের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী টাটার সঙ্গে জড়িত। প্রায় ২০ বছর তিনি এই ব্যবসা সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১২ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সরে দাঁড়ালেও পুরো টাটা গ্রুপের ওপর তাঁর বড় প্রভাব ছিল। সে কারণে তিনি সেরা ১০ বা ২০ শীর্ষ ভারতীয় ধনীর তালিকায় থাকবেন, সেটা আশা করাই যায়।
কিন্তু বাস্তবে সেসব তালিকায় রতন টাটার নাম ছিল না। ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে এর কারণ হিসেবে টাটাদের বিশাল দাতব্য কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। টাটা গ্রুপের আয়ের একটা বড় অংশই চলে যায় টাটা ট্রাস্টের কাছে। এর ফলে টাটা পরিবারের সদস্য কিংবা রতন টাটার হাতে খুব কম অর্থই থাকত।
ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেতজী টাটা। তাঁর নির্দেশ ছিল, টাটারা তাঁদের কোম্পানিগুলোর খুব বেশি শেয়ারের মালিক হবেন না। সুতরাং টাটা নামের কোম্পানিগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার কোনো টাটার হাতেই ছিল না। দ্বিতীয়ত, এমন নিয়ম ঠিক করা হয়েছিল যে টাটা সন্সের মাধ্যমে যা আয় করা হবে, তার বড় অংশই চলে যাবে টাটা ট্রাস্টের কাছে।
টাটারা অনেক আগে থেকেই নানা দাতব্য কাজে অর্থ খরচ করেন। বিল গেটস বিশ্বজুড়ে বড় দাতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার অনেক আগে থেকেই টাটা গোষ্ঠীর এ ক্ষেত্রে নামডাক ছিল।
পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন শিল্পপতি রতন টাটা। তিনি নিজে দানশীল ছিলেন। গতকাল বুধবার ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে তিনি টাটাকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কী ছিল না এই গ্রুপের ব্যবসার তালিকায়। সফটওয়্যার থেকে স্পোর্টস কার—সব ব্যবসাই ছিল টাটা গ্রুপের। বৈশ্বিক ব্যবসার জগতে টাটার নাম জানতেন সবাই।
অসম্ভব লাজুক একজন শিক্ষার্থী ছিলেন রতন টাটা। তাঁর স্বপ্ন ছিল স্থপতি হওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রে যখন তিনি কাজ করছিলেন, তখন তাঁর দাদি তাঁকে ভারতে ফিরে আসতে বলেন। এই দাদিই তাঁকে লালনপালন করেছিলেন। দাদির আদেশ ছিল, ভারতে ফিরে তাঁকে তাঁদের দ্রুত বর্ধনশীল পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে হবে।
১৯৬২ সালে তিনি টাটার হয়ে কাজ শুরু করেন। একটি হোস্টেলে থাকতেন তিনি। শিক্ষানবিশ হিসেবে রতন টাটা যেখানে কাজ করতেন, তার কাছেই ছিল চুলা। পরে বিরল এক সাক্ষাৎকারে তিনি সেসব দিনের কথা স্মরণ করেন এভাবে, ‘সেই সময়ে এটা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, সেই অভিজ্ঞতা খুব মূল্যবান ছিল। কারণ, আমি বছরের পর বছর শ্রমিকদের সঙ্গে থেকে হাতে–কলমে কাজ করেছি।’
রতন টাটা ১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের হাল ধরেছিলেন। সেই সময়ই ভারতে মুক্তবাজার অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর ফলে বাজার অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগাতে সরকার যেসব সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিল, তার পুরো সুবিধা নিতে পেরেছিল টাটা গ্রুপ।
দুই দশকের কিছু বেশি সময় তিনি টাটার কর্ণধার হিসেবে ভারতীয় এই কোম্পানিকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। লবণ থেকে শুরু করে ইস্পাতের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল যে কোম্পানি, সেটি একসময় ব্রিটেনের বিলাসবহুল গাড়ির জগতেও ঢুকে পড়ে। জাগুয়ার কিংবা ল্যান্ডরোভারের মতো গাড়ির কোম্পানির মালিকানা একসময় চলে আসে টাটার হাতে।