এক দিনেই আদানির সম্পদমূল্য বাড়ল ৫৫০ কোটি ডলার
অবশেষে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় ধনী গৌতম আদানি। আজ বুধবার দুটি খবরে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দর বেড়েছে ১০ শতাংশ আর আদানি উইলমার ও আদানি ট্রান্সমিশনের শেয়ারের দর বেড়েছে ৫ শতাংশ করে।
দর বাড়ার কারণে আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত শেয়ারের সম্মিলিত বাজার মূলধন গত কিছুদিন ধরে যেভাবে কমছিল তার গতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত বাজার মূলধন কমেছিল ১১৭ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। আজ বুধবার দিন শেষে বাজার মূলধন কমার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১০ বিলিয়ন বা ১১ হাজার কোটি ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের এক বিবৃতি আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিতে জাদুর মতো কাজ করেছে। তারা বলেছে, শেয়ারের দাম কমে গেলেও আদানিরা বন্ড ইনডেক্সের মধ্যে বাণিজ্য করতে পারবেন। এতেই আদানিদের ওপর ভরসা হারানো বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আশ্বস্ত হন। এর আগে মঙ্গলবার কাকতালীয়ভাবে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। সেখানে বলা হয়, আদানিরা ১১০ কোটি ডলারের ঋণ শোধের পরিকল্পনা করছে।
অথচ হিনডেনবার্গ আদানির ব্যাপারে যে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল আদানিদের বিপুল ঋণের দায় রয়েছে। ওই ঋণ শোধ করা আদানিদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন হিনডেনবার্গের ওই দাবি নস্যাৎ করে দেয়। ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মঙ্গলবারই আদানি শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১১০ কোটি ডলারের ব্যাংকঋণ পরিশোধ করেছে।
ইকোনমিক টাইমসের তথ্যানুসারে, ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি রুপির ঋণ আছে আদানিদের। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বিপুল অঙ্কের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন আদানি। এ জন্য ভারতের সংসদে বিরোধী দলগুলোও দাবি তুলেছিল, আদানির পাসপোর্ট জব্দ করার। যাতে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন। তবে এক দিনে বিপুল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করে সবাইকে চমকে দেন আদানি।
এ ছাড়া মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদানি গোষ্ঠী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আদানি এন্টারপ্রাইজ, আদানি পোর্ট, আদানি উইলমার, এসিসি ও আম্বুজা সিমেন্টের মুনাফার তথ্য প্রকাশ করে। সেখানে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানিগুলোর মুনাফা বেড়েছে। এমনকি কিছু কিছু কোম্পানির ভালো ব্যবসা করেছে বলেও আর্থিক প্রতিবেদনে জানানো হয়। যার ফলে আজ বুধবার শেয়ারবাজারে আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন শেয়ারের দাম বাড়ে।
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের তথ্যানুসারে, শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আজ বুধবার এক দিনেই গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পদ মূল্য ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫৫০ কোটি ডলার বেড়েছে। তাতে তিনি ফোর্বসের বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় ১৭ নম্বরে উঠে এসেছেন।
ঘর সামলানোর পরামর্শ
গত ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১২ দিনে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের বাজারমূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে যায়। তাতে আদানির ব্যক্তিগত সম্পদমূল্যও অর্ধেক কমে যায়। এতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েন তিনি। কঠিন এ বিপদের মধ্যেও সম্প্রতি ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেয়েছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় ধনী গৌতম আদানি। ১২০ কোটি ডলারে এই বন্দর কেনার চুক্তি হয়েছিল গত বছর। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে তা হস্তান্তর করা হয়। অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে গৌতম আদানি বিদেশি বিনিয়োগকারী ও অংশীদারদের উদ্দেশে বলেন, ‘কথা দিচ্ছি, আগামী দিনগুলোতে আমরা ভারতের আকাশরেখা বদলে দেব।’ কিন্তু বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার আগে আদানিকে নিজের ঘর সামলাতে হবে। কারণ তার ঘরে অনেক ফাঁকফোকর আছে, সেগুলো সবার আগে মেরামত করতে হবে তাঁকে। তাহলে বাজারে আস্থা ফিরবে।
পরীক্ষার মুখে ভারতের পুঁজিবাদ
হিনডেনবার্গ রিসার্চ প্রতিবেদনের ফলাফল গুরুতর বলেই মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকেরা। এ প্রতিবেদন শুধু আদানির ক্ষতি করেছে তা নয়; বরং ভারতীয় পুঁজিবাদকেও ইতিহাসের কঠিনতম পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের দ্য প্রিন্টের সম্পাদক শেখর গুপ্ত। সম্প্রতি দ্য প্রিন্টের অনলাইনে প্রচার হওয়া এক ভিডিওতে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের আগে ভারতে সেই অর্থে পুঁজিবাদ ছিল না। ভারতে এর আগেও বড় সংকট তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সংসদে অনেক আলাপ-আলোচনা ও উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এবারের সংকট তার চেয়ে ভিন্ন। কারণ, ভারত এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ফলে পুরো বিষয়টি ঘটছে বাজারের নিজস্ব নিয়মে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতে আসছেন। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আসছে—এ নিয়ে রাজনীতিকেরা অনেক গর্ব করেন। কিন্তু এফডিআই আসার সঙ্গে আরও অনেক কিছু আসে, সেটাও ভাবতে হবে।
এ কারণে আদানিকে নিয়ে হিনডেনবার্গে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করেছেন। গত ২৭ ও ৩০ জানুয়ারি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে ১৫০ কোটি ডলার তুলে নিয়েছেন।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কারও কথায় বিনিয়োগ করে না। নিয়মকানুন পরিপালন হচ্ছে কি না, সেটা তারা দেখবে। ফলে নিকট ভবিষ্যতে আদানি গোষ্ঠীর মাধ্যমে বাজারে বিনিয়োগ করার আগে তারা দ্বিতীয়বার ভাববে।
বিপুল অর্থ প্রয়োজন
দ্য ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে আদানি গোষ্ঠীর ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা। হিনডেনবার্গ প্রতিবেদনের পর তাঁর এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এমন ভাবার অবকাশ নেই। মুম্বাইয়ের কাছে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সমুদ্রবন্দর ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পোসকোর সঙ্গে যৌথভাবে ইস্পাত কারখানা নির্মাণ করতে চায় আদানি। এ ছাড়া নরেন্দ্র মোদি পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বে নাম করতে চান, সেই পরিকল্পনারও অংশীদার আদানি গোষ্ঠী। হাইড্রোজেন ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার কথা তাদের।
এসব বড় প্রকল্প করতে বিপুল অর্থ প্রয়োজন। আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও বা তালিকাভুক্ত কোম্পানির আরও বাড়তি শেয়ার ছেড়ে তোলার কথা ছিল ২৫০ কোটি ডলার। কিন্তু এই এফপিও পুরোপুরি বিক্রি হয়ে গেলেও দাম কমে যাওয়ার কারণে শেষমেশ বাজার থেকে তা প্রত্যাহার করে নেয় আদানি গোষ্ঠী।
এ ছাড়া আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দরপতনের কারণে ভারতের শেয়ারবাজারেও বড় প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি ভারতের ব্যাংকিং খাতেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কিন্তু দেশটির বৃহৎ ব্যাংক স্টেট অব ব্যাংক ইন্ডিয়া বলেছে, আদানি গোষ্ঠী তাদের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তাতে আশঙ্কার কিছু নেই। কারণ ঋণের বিপরীতে জামানত আছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, জেপি মরগ্যানের বিবৃতি ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনের বদৌলতে আদানির গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁদের নিয়ে তৈরি হওয়া বিনিয়োগকারীদের সব সন্দেহ দূর করতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোই এখন আদানির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।