চীনের প্রবৃদ্ধিতে টান, স্বস্তি না শঙ্কা

ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দা আসন্ন। তার সঙ্গে চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কমছে। এতে উন্নয়নশীল দেশের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে।

চীনের চোঙকিং অঞ্চলের একটি পাওয়ার টিলার কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। তবে দেশটির প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় কারখানায় উৎপাদন কমেছে। গতকালের ছবি
এএফপি

শূন্য কোভিড নীতির ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। গত বৃহস্পতিবার দেশটির ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার সর্বোচ্চ কমিটি পলিট ব্যুরোর এক বৈঠকে বলা হয়েছে, এ বছর চীনের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না–ও হতে পারে। সে জন্য তারা যৌক্তিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। তবে সেই যৌক্তিক হার যে কত, তা বলা হয়নি। এর আগে চীন সরকার ২০২২ সালের জন্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।

বিশ্বের সব দেশ যেখানে লকডাউন ও বিধিনিষেধের জায়গা থেকে সরে এসেছে, সেখানে চীন এখনো শূন্য কোভিড নীতিতে চলছে। যেখানে করানোর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, সেখানেই তারা লকডাউন আরোপ করছে। ফলে দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর–বন্দর কয়েক মাস ধরে একরকম বন্ধ। এখন তার ফল টের পেতে শুরু করেছে চীন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনও বৈশ্বিক চাহিদার অন্যতম চালিকা শক্তি। ফলে চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হলে বাংলাদেশের মতো রপ্তানিকারকদের স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতি হবে।
সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পলিট ব্যুরোর অর্থনৈতিক বৈঠকের পর চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেন, তাঁরা এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো যা করা যায়, সেটাই করার চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে চীনের যেসব প্রদেশ তুলনামূলকভাবে ভালো করছে, তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলছেন, চীন যে প্রবৃদ্ধির নতুন কোনো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেনি, বিষয়টি খুবই উল্লেখযোগ্য। যদিও অর্থনীতিবিদেরা আগেই বলেছিলেন, চীনের পক্ষে এ বছর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। আইএমজি ব্যাংকের চীনবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ আইরিস প্যাং বলেছেন, এ বছর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা চীনের জন্য আবশ্যক নয়।

সম্প্রতি এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৬ ও ৫ দশমিক ২ শতাংশ, এর মধ্যে চীন ও ভারতও আছে। এর আগে এডিবি বলেছিল, চলতি বছর চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশের মতো; তবে পরবর্তীকালে তা সংশোধন করে বলা হয়েছে, এবার প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৪ শতাংশ। আর ভারতের সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ বছর তাদের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ, যদিও এপ্রিল মাসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

চীনের বর্ধনশীল সম্পত্তির বাজার গভীর মন্দার কবলে পড়েছে। টানা ১১ মাস চীনে বাড়ি বিক্রি কমেছে। এই পরিস্থিতিতে চীনের বড় বড় ডেভেলপার গৃহ নির্মাণ বন্ধ রেখেছে। এমনকি যেসব ফ্ল্যাট আগেই বিক্রি হয়েছে, সেগুলোর নির্মাণকাজও বন্ধ। মূলত নগদ অর্থের সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কা থাকায় তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ শতাংশ। কিন্তু এপ্রিল-জুন প্রান্তিক শেষে দেখা গেছে, প্রত্যাশার অর্ধেকের কম, অর্থাৎ মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশটির অর্থনীতির। অর্থাৎ তারা সংকোচনের দোরগোড়ায়।

চীনের প্রবৃদ্ধির হার বেশ কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে কমছে। তবে এখন সংকটকালে তা প্রকটভাবে চোখে পড়ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, চীনে একধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। তারা এখন রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধি থেকে অভ্যন্তরীণ ভোগমুখী প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধির হার কমছে, কিন্তু তারা মনে করছে, এতে প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। এতে অনেক শিল্প অন্য দেশে চলে যাচ্ছে, যার সুযোগ বাংলাদেশসহ অন্যরা নিতে পারে।

আবার চীন যেমন রপ্তানিকারী, তেমনি বড় আমদানিকারীও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারাও বৈশ্বিক চাহিদার অন্যতম চালিকা শক্তি। ফলে চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হলে বাংলাদেশের মতো রপ্তানিকারকদের স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতি হবে বলে মনে করেন সেলিম রায়হান।

কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার সময় শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জেরে ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দা আসন্ন। তার সঙ্গে চীনের প্রবৃদ্ধির গতি কমছে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সামনে ভালো সময় অপেক্ষা করছে না বলেই বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন।