বিশ্বজুড়েই এখন চলছে মূল্যস্ফীতির দারুণ প্রকোপ। দেশে দেশে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের মূল্য। প্রতিদিনের জীবনযাত্রা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ, তাঁদের কাটছাঁট করতে হচ্ছে খাদ্যতালিকায়। এ অবস্থায় বিভিন্ন দেশে কর্তৃপক্ষ জনগণকে নানা রকম পরামর্শও দিচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া খবরে বলা হচ্ছে, কোনো দেশে সরকার জনগণকে মুরগির মাংসের বদলে মুরগির পা খেতে বলেছে। আবার কোনো দেশে হয়তো পেঁয়াজের দাম বেশি, তাই বিয়েতে ফুলের তোড়ার পরিবর্তে কনে হাতে নিচ্ছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেঁয়াজের তৈরি তোড়া। কোথাও আবার বই বিক্রি হচ্ছে কিস্তিতে।
মানুষ যখন করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। তার ওপর বেশির ভাগ দেশে এখন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা মূল্য হারাচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে।
দেখে নেওয়া যাক, কোন দেশের মূল্যস্ফীতি সে দেশের মানুষের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে। বিবিসি নিউজ অনলাইন, রয়টার্স ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, উঁচু মূল্যস্ফীতির হার কয়েকটি দেশে মানুষের জন্য কীভাবে তীব্র ভোগান্তির কারণ হচ্ছে।
মিসর
মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আফ্রিকার দেশ মিসর। দেশটিতে তরতর করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। মার্চ মাসে মিসরে মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ২১ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় যা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এতটাই ভয়ংকর রূপ নিয়েছে যে অনেকেই মাংস কিনতে পারছেন না। তাই সরকার এদের মুরগির মাংসের পরিবর্তে মুরগির পা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। দেশটিতে সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও এখন বিলাসবহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গত কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেড়েছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, মিসরের গির্জা বাজারে পোলট্রি বিক্রেতাদের পাশে ভিক্ষা করতে থাকা একজন ব্যক্তি এই বলে প্রার্থনা করছিলেন, ‘আমাদের মুরগির পা খেতে হবে এমন অবস্থায়’ যেন না পড়তে হয়।
ওয়েদাদ নামে একজন ক্রেতা বলেন, ‘আমি বাজার করতে গেলে এক বিক্রেতা এক কেজি হাড় ছাড়া মুরগির দাম চায় ১৬০ মিসরীয় পাউন্ড। কেউবা চায় ১৭৫ পাউন্ড, কেউ ১৯০, এমনকি ২০০ পাউন্ডও চায় অনেকে।’
ওয়েদাদ বলেন, ‘মুরগির পুরো পা ৯০ মিসরীয় পাউন্ড। মুরগির হাড়ও এখন বিক্রি হয়। আর শুধু পায়ের নিচের অংশ নিলে দাম ২০ মিসরীয় পাউন্ড।’
মিসরে এখন একটি বইও বিলাসপণ্য হয়ে উঠেছে। দেশটিতে বইয়ের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। মানুষ সাধারণত গাড়ির মতো বিলাসী জিনিস কেনে কিস্তিতে। কিন্তু মিসরে এখন বইও বিক্রি হচ্ছে কিস্তিতে। বোঝাই যাচ্ছে, দেশটিতে মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে।
কাগজ ও কালির দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে মিসরে। এক টন কাগজের দাম বছরের শুরুতে যা ছিল, এখন তার তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে।
কিছু মিসরীয় লেখক বলেছেন যে বইয়ের চাহিদা কমে গেছে। খরচ কমানোর জন্য লেখকেরা বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন। অনেকেই আবার বিদেশে বই ছাপানোর দিকে ঝুঁকছেন।
মিসর আমদানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। গত বছর দেশটির মুদ্রা পাউন্ড মার্কিন ডলারের বিপরীতে অর্ধেক মূল্য হারিয়েছে। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফলে মিসরীয়দের ব্যয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দেশটি কয়েক বছর পার করে ফেলেছে।
ফিলিপাইন
ফিলিপাইনে দ্রব্যমূল্য ক্রমবর্ধমান রয়েছে। ২০০৮ সালের পর গত ডিসেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ হয়েছে। খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে দেশটিতে খাবার থেকে জ্বালানি পর্যন্ত সবকিছুর দাম বেড়ে ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ফিলিপাইনের পরিসংখ্যান দপ্তর জানিয়েছে, ডিসেম্বরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে।
ওই মাসেই পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ৭০০ পেসো ছুঁয়েছে—বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ হাজার ৩৫০ টাকারও বেশি দাঁড়ায়। ফিলিপাইনে মাংসের চেয়ে পেঁয়াজের দাম বেশি। বস্তুত পূর্ব এশিয়ার দেশটির দৈনিক ন্যূনতম মজুরির চেয়েও এখন পেঁয়াজের দাম বেশি।
পেঁয়াজের দাম এতটাই বেড়েছে যে লাইকা বিয়োরে নামের এক যুবতী জানিয়েছেন তিনি ইলোইলো শহরে আয়োজিত তাঁর বিয়েতে ফুলের তোড়ার পরিবর্তে পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি তোড়া বেছে নিয়েছিলেন।
পাকিস্তান
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে মাসিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। নানা অর্থনৈতিক সংকটে এখন জর্জরিত পাকিস্তান।
অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দরপতন চলছেই। আন্তব্যাংক বাজারে প্রতি ডলারের দর দাঁড়িয়েছে ২৮৭ দশমিক ২৯ রুপি। এতে রুপির দর ইতিহাসের সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে।
পাকিস্তানে প্রতি লিটার হাইস্পিড ডিজেলের দাম ২৮০ রুপি এবং পেট্রলের দাম ২৭২ রুপিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশটিতে খোলা চায়ের দাম ১ হাজার ১০০ রুপি থেকে বেড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার ৬০০ রুপিতে পৌঁছেছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩০ শতাংশ। তখন পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩০০ রুপি, যা আগে ছিল ৫০ রুপি। আলুর দাম চার গুণ বেড়ে প্রতি কেজি ১০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। তখনই নিত্যপণ্যের দাম অত্যন্ত বেশি ছিল। আটা, ডাল, চাল, দুধ—বলা যায় সবকিছুরই দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার ১০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তিন দশকের মধ্যে এই বছরেই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখল দেশটি। আর্জেন্টিনার পরিসংখ্যান সংস্থা ইনডেক সম্প্রতি জানায় যে ফেব্রুয়ারিতে আর্জেন্টিনায় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ।
লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। মূলত কয়েক দশক ধরে চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগতে থাকার কারণেই আর্জেন্টিনায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ বছরের মার্চে দেশটিতে প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ১৯৩ আর্জেন্টাইন পেসো, চিনি ২৬১ পেসো, লবণ ২৩৮ পেসো, আলু ৩৬৯ পেসো, পেঁয়াজ ৩৯৯ পেসো, রান্নার তেল প্রতি লিটার ৩১১ পেসো এবং মুরগির মাংসের কেজি ৭৪৯ পেসো। এসব মূল্য আগের তুলনায় অনেক বেশি।