ব্রিকসে নতুন সদস্য চায় চীন, তবে ‘সতর্ক’ অবস্থানে ভারত ও ব্রাজিল
বিকাশমান অর্থনীতির পাঁচটি দেশের জোট ব্রিকসে নতুন সদস্য নেওয়ার যে পরিকল্পনা চলছে, তাতে জোটের সবাই সমর্থন জানাচ্ছে না। বিশেষ করে ভারত এই পরিকল্পনার বিষয়ে ‘সতর্ক’ অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন এই জোটের দিকে লক্ষ রাখেন, এমন বিশ্লেষকেরা। বর্তমানে যেসব আঞ্চলিক জোট রয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে ব্রিকস কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দেহ বাড়ছে।
সাউথ চায়না মনিং পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, আগামী মাসে ব্রিকসের সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা জোহানেসবার্গে এক বৈঠকে বসবেন বলে কথা রয়েছে। সেখানে আলোচনা হবে কাদের নতুন সদস্য হিসেবে জোটে নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত আগ্রহীদের তালিকায় রয়েছে আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, বাংলাদেশ ও ইরান।
জোটের জেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তিন দিনের একটি বৈঠক মঙ্গলবারে শুরু হয়েছে। ওই বৈঠকে জোট সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
ব্রিকসের শুরু একটি শিথিল জোট হিসেবে। লক্ষ্য ছিল দেশগুলোর মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং সহযোগিতা বাড়ানো। বিশ্বের ৪৩ শতাংশ জনসংখ্যা বাস করে জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পৃথিবীর ২৬ শতাংশ ভূমি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ৩০ শতাংশের মালিক এসব দেশ।
চীন গত বছর জানায় যে জোটে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হোক, এটা সে চায়। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর গত মাসে বলেছেন যে এই প্রক্রিয়া ‘এখনো চলমান’। তিনি বলেন, জোটের সম্প্রসারণ করা হলে এটির কাঠামো ঠিক কী হবে, সে ব্যাপারে মান, অনুমাপক এবং পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।
ব্রাজিলের ফুন্ডাকাও গেটুলিও ভারগাস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অলিভার স্টুনকেল বলেন, ‘জোট কতটা সম্প্রসারিত হলে তা নতুন দিল্লির স্বার্থের অনুকূলে’ থাকবে, তা নিয়ে ভারতের একটি উদ্বেগ আছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এ ব্যাপারে লক্ষণীয় কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয় কি না, তা দেখতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’
তাঁর মতে, জোট সম্প্রসারণে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী চীন। এরপর রয়েছে রাশিয়া। তবে ভারত ও ব্রাজিল এ ব্যাপারে কমবেশি ‘সতর্ক রয়েছে যে সম্প্রসারিত জোটে তাদের প্রভাব কমে যায় কি না’ এটা ভেবে। তিনি বলেন, ‘নতুন সদস্যরা চীনের ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে, ব্রাজিল কিংবা ভারতের নয়।’
অলিভার স্টুনকেল আরও বলেন, জোটটি এরই মধ্যে পশ্চিমের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একই সঙ্গে এটিকে শক্তিশালী জি৭ গ্রুপের বিকল্প মডেল হিসেবেও দেখা হচ্ছে। জি৭ গোষ্ঠীর সদস্যরা হলো ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি আরও যোগ করেন, ব্রিকস জোটের সম্পসারণ হোক বা না হোক, এর সদস্যদেশগুলোর নিজস্ব অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।
ভারতের ভূমিকা
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ফেলো আনু আনোয়ার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত যে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে রয়েছে, তা ধারণা দিচ্ছে ব্রিকস জোটে তাদের অবস্থান ‘বিচ্ছিন্ন’ এবং এটা বোধগম্য যে অন্য সদস্যরা এই জোটের সম্প্রসারণ চায়।
দিল্লি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা জোরদার করেছে। এ ছাড়া কোয়াড নিরাপত্তা জোটেও ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ভারত ছাড়াও এই জোটে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। বিশ্বে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকার কারণে জোটটি সম্প্রতি পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে।
আনু আনোয়ার মনে করেন, ব্রিকস জি৭ জোটের বিকল্প হিসেবে দাঁড়ানোর বিষয়টি সম্ভবত ঘটবে না। তিনি বলেন, ‘ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নিজস্ব কোনো সামরিক জোট নেই এবং কাছাকাছি সময়ে যে তা হবে, তেমন সম্ভাবনা খুবই কম।’ তাঁর মতে, একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে এমন একটি সামরিক জোট গঠন করা গুরুত্বপূর্ণ।
জার্মানির ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক গুন্থার মাইহোল্ড বলেন, একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা মূলত চীন ও রাশিয়ার স্বার্থ। তাঁর মতে, এই দুই দেশ তাদের আকাঙ্ক্ষাকে একধরনের বৈধতা দিতে ব্রিকসের সম্প্রসারণ চায়। অন্যদিকে ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনে আগ্রহী নয়।
গুন্থার মাইহোল্ড বলেন, এটা সম্ভবত ‘অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বিশেষভাবে ভারত ও চীনের মধ্যকার সীমান্ত সংঘাতের কারণে তৈরি হওয়া খারাপ সম্পর্কের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং বলেন যে দেশ দুটি আরও বেশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব তৈরির জন্য প্রতিযোগিতা করছে।
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অ্যাশ সেন্টারের জেষ্ঠ ফেলো শার্লি জে ইয়ু বলেন, ব্রিকস সম্পসারিত হলে তা এই জোট ও বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের দিকটি প্রতিফলতি করবে, কারণ ব্রিকসের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দুই–তৃতীয়াংশই আসে চীন থেকে।
তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগে সদস্য দেশই একটি সাধারণ বহুপক্ষীয় কাঠামোর কথা বলবে, তবে চীন ঠিক করে দেবে যে কী নিয়ম পালন করতে হবে।’ তিনি আরও মনে করেন, কোনো একটি দেশ এমন ভূমিকা পালন করলে তার প্রতিপত্তি দশকের দশক ধরে চলতে থাকে।
পশ্চিমা দেশগুলো যেমন একটি সাধারণ মতাদর্শ ধারণ করে, ব্রিকসের দেশগুলো তা করে না বলে মত দেন শার্লি জে ইয়ু। তিনি বলেন, বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর উন্নয়ন চাহিদা প্রতিফলিত হয়, এসব দেশ এমনভাবে বর্তমানে প্রচলিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে চায়।
উন্নয়নের অর্থায়ন
ব্রিকস জোট নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) প্রতিষ্ঠা করে ২০১৫ সালে। বিকাশমান দেশগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিতে এর প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই রকম লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল চীনের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।
প্রতিষ্ঠার পর এনডিবি এখন পর্যন্ত ৫টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশে ৯৬টি প্রকল্পে তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। ব্রিকসের ওয়েবসাইটে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে।
মে মাসে ব্যাংকের বার্ষিক সভায় চীনের উপ প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েজিয়াং বলেন যে বেইজিং এনডিবিকে একটি উন্মুক্ত বহুজাতিক ব্যাংক হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর মতে, বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোতে অবকাঠামো ও বিভিন্ন টেকসই প্রকল্পে তহবিল জোগাতে এনডিবি সবচেয়ে ভালো কাজ করতে পারে।
এনডিবিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে। যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে উরুগুয়ে। আর এনডিবিতে যোগ দিতে আলোচনা চালাচ্ছে সৌদি আরব।
ব্রাজিলের ফুন্ডাকাও গেটুলিও ভারগাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলিভার স্টুনকেল বলেন, ব্যাংকে যেহেতু আগেও সদস্য বাড়ানো হয়েছে, তাই আরও নতুন সদস্য যোগ দিতে পারে। এটি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে ঠেকিয়ে দেওয়ায় সক্ষম বলেও মনে করেন তিনি।
‘এটি অবশ্য ইতিমধ্যেই তা করছে,’ বলেন তিনি। একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী এনডিবির প্রয়োজনীয়তা উন্নয়নশীল বিশ্ব অনুভব করে বলেও মনে করেন তিনি।
তবে আনু আনোয়ারের মতে, এনডিবির যে সম্পদ রয়েছে এবং তাদের যে কাজের ধরন, তাতে করে তারা কেবল একটি সম্পূরক ভূমিকাই পালন করতে পারে এবং বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের জায়গা নিতে অপারগ।
তিনি বলেন, এনডিবিতে ‘নতুন সদস্য নিলে তা অবশ্য আরও বেশি পুঁজি আনবে এবং অবকাঠামোখাতে তারা আরো বেশি কাজ করতে পারবে।’ তবে আর্থিক বাজারে নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যে ভূমিকা পালন করে, এনডিবির এসব কাজ তাকে মুছে ফেলতে পারবে না।