ভারতের শেয়ারবাজার থেকে বিদেশিরা বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন
ভারতের শেয়ারবাজার ঘিরে নাটকীয়তার শেষ হচ্ছে না। নতুন সরকারের শপথের পর দেশটির শেয়ারবাজার নতুন রেকর্ড গড়লেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যেন অনিশ্চয়তা কাটছে না। জানা গেছে, জুনের প্রথম সপ্তাহেও বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
টাইমস অব ইন্ডিয়া সূত্রে জানা যায়, লোকসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ পর্বের শেষে বুথফেরত সমীক্ষার সম্ভাব্য ফলাফলের ওপর নির্ভর করে বড় লাফ দেয় ভারতীয় শেয়ারবাজার। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, বুথফেরত সমীক্ষার সঙ্গে ফল মিলছে না। তার জেরে এক দিনে ৪০০০ পয়েন্টের বেশি পড়ে যায় সেনসেক্স। সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি তুলে নেওয়া অব্যাহত থাকে।
শেয়ারবাজারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুনের প্রথম সপ্তাহেই ভারতের শেয়ারবাজার থেকে নিট ১৪ হাজার ৭৯৪ কোটি রুপি তুলে নিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, যদিও এ সময়ে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভারতের আর্থিক পরিস্থিতির তুলনায় বাজার বেশি মূল্যায়িত। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঠিক সে কারণে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। জানা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে সরে গিয়ে আপাতত চীনের অপেক্ষাকৃত ‘আকর্ষণীয়’ বাজারে বিনিয়োগ করছেন।
এই প্রবণতা একেবারে হঠাৎ করে এখন দেখা যাচ্ছে, তা নয়। চলতি বছরের শুরু থেকেই ভারতের শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি পুঁজি সরে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, যদিও প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সূচক নতুন রেকর্ড উচ্চতায় উঠছে।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, মে মাসে নির্বাচনসংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে নিট ২৫ হাজার ৫৮৬ কোটি রুপির বিদেশি বিনিয়োগ ভারতের বাজার থেকে চলে গেছে। এপ্রিলে মরিশাসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কর চুক্তিতে পরিবর্তনসংক্রান্ত উদ্বেগের জেরে ৮ হাজার ৭০০ কোটি রুপি তুলে নেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে যথাক্রমে নিট ১ হাজার ৫৩৯ কোটি ও ৩৫ হাজার ৯৮ কোটি রুপি বিনিয়োগ আসে দেশটির শেয়ারবাজারে। এর আগে জানুয়ারি মাসে চলে গিয়েছিল ২৫ হাজার ৭৪৩ কোটি রুপি। সব মিলিয়ে এ বছর শেয়ারবাজার থেকে নিট ৩৮ হাজার ১৫৮ কোটি রুপি তুলে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা, দেশটির যদিও ঋণপত্রের বাজারে সেই সময় ৫৭ হাজার ৬৭৭ কোটি রুপি বিনিয়োগ এসেছে।
মর্নিংস্টার ইনভেস্টমেন্ট রিসার্চ ইন্ডিয়ার গবেষণা শাখার প্রধান হিমাংশু সাক্সেনা বলেন, নির্বাচনের ফলের ধাক্কা চলতি মাসে পুঁজি চলে যাওয়ার বড় কারণ। কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কয়েক দিন আপাতত পরিস্থিতির দিকে নজর রাখবেন।
এদিকে ব্লুমবার্গের সূত্রে টাইমস অব ইন্ডিয়া সম্প্রতি জানিয়েছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চীন বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে; সে কারণে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের পুরোনো প্রিয় বাজার চীনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাঁদের মনে আশাবাদ, অর্থনীতি চাঙা করতে বেইজিং যে প্রণোদনা দিচ্ছে, তাতে চীনের শিল্প খাতের মুনাফা বাড়বে, উৎপাদনও বাড়বে।
বিনিয়োগকারীদের এই প্রবণতায় বোঝা যাচ্ছে, চীনের বাজারের বিষয়ে তাঁরা ক্রমেই আরও আশাবাদী হয়ে উঠছেন। ওয়াল স্ট্রিটের বড় ব্যাংকগুলো এখনো মনে করে, আগামী এক দশক বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হবে ভারতের শেয়ারবাজার। যদিও বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়ে সতর্ক যে ভারতের বাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির স্টক অতিমূল্যায়িত হচ্ছে। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে।
বিরোধীদের অভিযোগ
ভারতের বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন ঘিরে ভারতের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা সাকেত গোখলে ইতিমধ্যে ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
সাকেত গোখলের বক্তব্য, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে মানুষকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটি। তাঁদের এই মন্তব্যের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে কারচুপি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। ৩ ও ৪ জুন শেয়ারবাজারে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কারণে মোদি, শাহ বা বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনো কোম্পানি মুনাফা করেছে কি না, সেটাও তদন্ত করা প্রয়োজন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ৪ জুনের পরে বাজার এতটা ওপরে উঠবে যে সূচক রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে যাবে। অমিত শাহও সাধারণ মানুষকে ৪ জুনের আগে শেয়ার কিনে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ৪ জুনের পর বাজারের উত্থান হবে। বুথফেরত সমীক্ষায় বিজেপির বিপুল বিজয়ের ইঙ্গিত পাওয়ার পর নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল সূচক। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় ফল প্রকাশের দিন ৪ হাজার পয়েন্টের বেশি পড়ে যায় সেনসেক্স-বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় ৩১ লাখ কোটি টাকা রুপি।
শেয়ারবাজার নিয়ে ভারতের শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের এ ধরনের মন্তব্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই বাজারের ফাটকাবাজি নিয়ে আরও সতর্ক হবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।