লেনদেনে ভারসাম্য, বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি মেটানো, বাজেটসহায়তা ও জলবায়ুসংকট মোকাবিলার মতো বিভিন্ন প্রয়োজনে সদস্যদেশগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এই ঋণ দেওয়া হয় সংস্থাটির নিজস্ব অর্থব্যবস্থা স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআরের মাধ্যমে। কিন্তু কোথা থেকে এত অর্থ পায় আইএমএফ? তাদের দেওয়া ঋণে সুদের হারইবা কেমন, তা থাকছে এই প্রতিবেদনে।
এসডিআর কী
স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর হলো আইএমএফের একধরনের নিজস্ব অর্থব্যবস্থা। আইএমএফের সম্পদ ও ঋণকে এসডিআর এককে গণনা করা হয়। তবে এটি নিজে কোনো মুদ্রা নয়, একটি ধারণামাত্র। এসডিআরের মান ধরা হয় মার্কিন ডলার, ইউরো, চীনা রেনমিনবি, জাপানি ইয়েন ও পাউন্ড—এই পাঁচ মুদ্রার আনুপাতিক গড় হিসাব করে। তবে বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এর মূল্যমানকে সমর্থন করে। যেকোনো মুদ্রার সঙ্গে এই ভার্চ্যুয়াল সম্পদকে বিনিময় করা যায়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আইএমএফের এসডিআরকে যেকোনো মুদ্রায় নিজেদের রিজার্ভে গণনা করতে পারে। এর মাধ্যমে একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে যায়। নিয়মিত এসডিআরের মূল্যমান হালনাগাদ করা হয়। গত শুক্রবার ১ এসডিআরের মূল্যমান ছিল ১ দশমিক ৩৩ মার্কিন ডলার।
কোথা থেকে অর্থ পায় আইএমএফ
মূলত তিনটি উৎস থেকে আইএমএফ তহবিল বা অর্থ সংগ্রহ করে। এক. সদস্য চাঁদা বা কোটা। দুই. ঋণ গ্রহণ। তিন. দ্বিপক্ষীয় ঋণচুক্তি। আইএমএফের সদস্যের মধ্যে কোন দেশ কত টাকা চাঁদা দেবে, তা কোটা আকারে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। একটি দেশের প্রদত্ত চাঁদার পরিমাণ বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির অর্থনৈতিক আকারের সঙ্গে সংগতি রেখে নির্ধারণ করা হয়। এই চাঁদাই সংস্থাটির আয়ের প্রধান উৎস। তবে কোনো সদস্যদেশ চাইলে নির্ধারিত কোটার বেশি চাঁদা দিতে পারে।
সদস্যদের চাঁদা থেকে আইএমএফের তহবিলে জমা আছে প্রায় ৪৭ হাজার ৬২৭ কোটি ২০ লাখ এসডিআর। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে ১০৬ কোটি ৬৬ লাখ এসডিআর, যা মোট এসডিআরের দশমিক ২২ শতাংশ।
এ ছাড়া সদস্যরাষ্ট্র থেকে প্রয়োজন হলে আইএমএফ ঋণ নেয়। এটিও সংস্থাটির আয়ের একটি উৎস। এর পাশাপাশি সদস্যদেশগুলোকে আইএমএফ ঋণসহায়তা দেয়। এ থেকে সুদবাবদ যে অর্থ আসে, সেটাও সংস্থাটির আয়ের বড় উৎস।
কত অর্থ আছে আইএমএফের কাছে
১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ মিলে আইএমএফ গঠন করে। বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টি দেশ আইএমএফের সদস্য। সদস্য চাঁদা ও অন্যান্য আয় মিলিয়ে বর্তমানে আইএমএফের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯৭ হাজার ৭০০ কোটি (৯৭৭ বিলিয়ন) এসডিআর। এর মধ্যে ঋণ দেওয়ার পর্যায়ে রয়েছে ৭১ হাজার ৩০০ কোটি (৭১৩ বিলিয়ন) এসডিআর। একে মার্কিন মুদ্রায় প্রকাশ করলে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি মার্কিন ডলার হয়।
যত ধরনের ঋণ কর্মসূচি রয়েছে
মোটাদাগে আইএমএফ তিন ধরনের তহবিল থেকে ঋণ দেয়। এক. সাধারণ সম্পদ হিসাব (জিআরএ)। দুই. দারিদ্র্য হ্রাস ও প্রবৃদ্ধি ট্রাস্ট (পিআরজিটি)। তিন. নতুন গঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট (আরএসটি) তহবিল। এর মধ্যে জিআরএ তহবিল থেকে বাজারভিত্তিক সুদহারনির্ভর কঠিন শর্তের ঋণ দেওয়া হয়। এটি যেকোনো সদস্যদেশ নিতে পারে। পিআরজিটি তহবিল থেকে দেওয়া হয় নমনীয় শর্তের ঋণ। এটি মূলত নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য। এ ধরনের ঋণে বর্তমানে কোনো সুদ দিতে হয় না। আর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনাভাইরাসের মতো দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরএসটি তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয়। আইএমএফের এই তিনটি তহবিলের অধীনে আবার ১৩ ধরনের ঋণ কর্মসূচি রয়েছে। আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ বিভিন্ন ঋণ কর্মসূচির জন্য বিভিন্ন সুদহার নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশ প্রথম কখন ঋণ নেয়
ছোট-বড় আকার মিলিয়ে আইএমএফ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১ বার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবার নেয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৮০-৯০ সময়ে পাঁচবার ঋণ নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে আইএমএফের অন্যতম শর্ত ছিল মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা। ২০০৩ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনার শর্তে ঋণ নেয় বাংলাদেশ। প্রায় এক দশক পর ২০১২ সালে সাত কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। এর অন্যতম শর্ত ছিল নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা। এ আইন করতে দেরি করায় শেষের দুই কিস্তি আটকেও দিয়েছিল আইএমএফ। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে সংস্থাটি।