আদানির সাম্রাজ্য কাঁপানো ‘হিনডেনবার্গ’ কারা
আর্থিক বিষয়ে গবেষণা করে হিনডেনবার্গ রিসার্চ। তবে কেবল গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান। তারা লক্ষ্যবস্তু বানায় একেকটি কোম্পানিকে। গত মাসের শেষে তাদের টার্গেট ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং ভারতের অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত গৌতম আদানি।
পুরো পৃথিবীতে তোলপাড় ফেলে হিনডেনবার্গ অভিযোগ করে, ভারতের এই ধনকুবেরের কোম্পানি আদানি গ্রুপ শেয়ার নিয়ে জালিয়াতি আর হিসাব–নিকাশের ক্ষেত্রে ধোঁকাবাজি করেছে। তারা জানায়, দুই বছর ধরে আদানি নিয়ে তারা গবেষণা করেছে, কথা বলেছে আদানি গ্রুপের সাবেক শীর্ষস্থানীয় নির্বাহীদের সঙ্গে, আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে হাজার হাজার দলিল-দস্তাবেজ।
এসব অভিযোগ খারিজ করে দিতে গৌতম আদানি অবশ্য একেবারেই সময় নষ্ট করেননি। গত ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর এর প্রতিক্রিয়ায় ৪১৩ পৃষ্ঠার জবাব দেয় আদানি গোষ্ঠী। তাদের অভিযোগ, হিনডেনবার্গ স্বল্পমেয়াদি মুনাফার জন্য এ প্রতিবেদনে দিয়েছে এবং এটা ভারতের অগ্রগতি রোখার চক্রান্ত।
তবে পাল্টা তোপ দেগে হিনডেনবার্গ বলে, আদানি ভারতীয় পতাকায় শরীর মুড়িয়ে দেশ লুট করেছেন।
জীবনে খুব বেশি পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেননি গুজরাট থেকে উঠে আসা ৬০ বছর বয়সী গৌতম আদানি। কিন্তু দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে তাঁর জীবনে যা ঘটে গেছে, তাতে তিনি হারিয়েছেন পৃথিবীর তৃতীয় শীর্ষ ধনীর মুকুট। আর এখন পর্যন্ত সম্পদ হারিয়েছেন ১০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি।
হিনডেনবার্গ রিসার্চ কারা
নিজেদের ‘ফরেনসিক আর্থিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান’ হিসেবে পরিচয় দেয় হিনডেনবার্গ রিসার্চ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ব্যবসার জগতে অব্যবস্থাপনা এবং হিসাবের অনিয়মের মতো দুর্নীতি এবং জালিয়াতি খুঁজে বেরোয়। তারা বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ, ঋণ ও শেয়ারের মতো বিষয়গুলো। নিজেদের ওয়েবসাইটে হিনডেনবার্গ ঘোষণা করেছে যে তারা ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগ’ সম্পর্কে খোঁজখবর করে।
কোম্পানিটি নিজেরাই বিনিয়োগ করে। ২০১৭ সালে নাথান অ্যান্ডারসন এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
একসময়ের আলোচিত হিনডেনবার্গ এয়ারশিপের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৩৭ সালে নিউজার্সিতে উড়ে যাওয়ার সময় এই এয়ারশিপে আগুন লেগেছিল। হিনডেনবার্গের বক্তব্য হলো, ওটা ছিল ‘মানবসৃষ্ট’ এমন একটি ‘দুর্যোগ, যা পুরোপুরিভাবে এড়ানো যেত’। তারা এ–ও বলে, তারা আর্থিক বাজারে একই রকম দুর্যোগ খুঁজে ফেরে, যাতে ‘আরও বেশি সাধারণ মানুষ লোভের শিকার না হয়’।
সম্ভাব্য অনিয়ম খুঁজে পাওয়ার পর হিনডেনবার্গ সাধারণত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং লক্ষ্যবস্তু বানানো কোম্পানির বিপক্ষে বাজি ধরে। উদ্দেশ্য, কিছু লাভ করা।
হিনডেনবার্গের প্রতিষ্ঠাতা
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনির্ভাসিটি অব কানেক্টিকাট থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে স্নাতক করেছেন নাথান অ্যান্ডারসন। এরপর ডেটা কোম্পানি ফ্যাক্টসেট রিসার্চ সিস্টেমসে বিভিন্ন বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির জন্য কাজ শুরু করেন।
‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম তারা খুব বেশি সংখ্যায় সাধারণ মানের কাজ করছে, যেগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটির সাদৃশ্য রয়েছে,’ ২০২০ সালে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি।
এর আগে অ্যান্ডারসন খুব অল্প সময়ের জন্য ইসরায়েলে একজন অ্যাম্বুলেন্সের চালক হিসেবে কাজ করেন। তার লিঙ্কডইন পাতায় তিনি লেখেন যে এই কাজ তাঁকে ‘ভয়ানক চাপের মধ্যে চিন্তা করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করার অভিজ্ঞতা’ দিয়েছিল। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে অ্যান্ডারসন বলেছিলেন, বার্নি ম্যাডফ জালিয়াতি সম্পর্কে যিনি প্রথম সতর্ক করেছিলেন, সেই হ্যারি মারকোপোলো তাঁর আদর্শ।
হিনডেনবার্গের সবচেয়ে বড় বাজি
ইলেকট্রিক ট্রাক বানানোর কোম্পানি নিকোলা করপের বিপক্ষে বাজি ধরেছিল হিনডেনবার্গ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে আলোচিত বাজির ঘটনা। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে অ্যান্ডারসন বলেছিলেন, এটা ছিল তাঁর জন্য বিশাল এক বিজয়। তবে তিনি বলেননি যে ঠিক কী পরিমাণ লাভ হয়েছিল তাঁর ওই বাজি থেকে।
হিনডেনবার্গ বলেছিল যে নিকোলা তার প্রযুক্তি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ভ্রান্ত ধারণা দিয়েছে। নিকোলার ইলেকট্রিক ট্রাক অতি দ্রুতগতিতে চলেছে—এমন একটি ভিডিওকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অ্যান্ডারসন। আসল ঘটনা ছিল, ট্রাকটি একটি টিলা থেকে নিচে নামছিল। মিথ্যা বলার অভিযোগে নিকোলার প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টনকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ২০২১ সালে তিনি মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে রাজি হন।
শেয়ারবাজারে যে কোম্পানির মূল্য ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পর্যন্ত উঠেছিল, সেই নিকোলার বর্তমান মূল্য হলো মাত্র ১৩৪ কোটি ডলার। অ্যান্ডারসন বলেছিলেন, কোম্পানিটির সাবেক ও বর্তমান কর্মীদের কাছ থেকে তিনি খবর পেয়েছিলেন।
আরও যাদের টার্গেট করেছিল হিনডেনবার্গ
হিনডেনবার্গের ওয়েবসাইট বলছে, ২০১৭ সাল থেকে কমপক্ষে ১৬টি কোম্পানির সম্ভাব্য অনিয়ম তারা উদ্ঘাটন করেছে। এর মধ্যে একটি ছিল টুইটার।
হিনডেনবার্গের এসব গবেষণা আর প্রতিবেদন তাদের টাকা বানাতে সাহায্য করে। যেসব কোম্পানিকে তারা লক্ষ্যবস্তু বানায়, তাদের ক্ষেত্রে হিনডেনবার্গ কখনো ‘শর্ট’ আবার কখনো ‘লং’ অবস্থান নেয়। আর এর ফলে শেয়ারের দাম ওঠানামা করে, আর লাভের অর্থ ঘরে তোলে হিনডেনবার্গ।