আইএমএফের শর্ত মেনে শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠনের চেষ্টা
গত বছর ঋণখেলাপি হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা এখন মরিয়া হয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
ঋণ পুনর্গঠনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তানুযায়ী দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ২০৩২ সালের মধ্যে মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপি তথা মোট দেশজ উৎপাদনের ৯৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে চায়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আইএমএফ যে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেইল আউট বা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি অনুমোদন করেছে, মূলত তার শর্ত পূরণেই অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে দ্য সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা। গত বছর ঋণখেলাপি হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা এখন মরিয়া হয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
শ্রীলঙ্কা বেইল আউট বা আর্থিক পুনরুদ্ধারের জন্য আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের চেষ্টা করে চলেছে। এর মধ্যে আছে ভর্তুকি কমানো, কর সংগ্রহ দ্বিগুণ করা ও শত শত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণ। সব শর্ত পূরণের পরেই দেশটি ঋণ পুনর্গঠনের এই পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
আইএফএমের সঙ্গে সম্পাদিত বেইল আউট চুক্তি অনুযায়ী, আর্থিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আগামী চার বছরের মধ্যে দেশটির ঋণ দুই–তৃতীয়াংশ কমাতে হবে।
এবার দেখে নেওয়া যাক, অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠনে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণদাতাদের চার ধরনের বিকল্প দিয়েছে। প্রথমত, শ্রীলঙ্কায় স্থানীয়ভাবে জারি করা ডলারভিত্তিক বন্ড। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বন্ডের জন্য যে শর্ত রয়েছে, সেটিই শ্রীলঙ্কা ডেভেলপমেন্ট বন্ডের (এসএলডিবি) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এই বন্ডের মূল অঙ্কের পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমিয়ে এর মেয়াদকাল ছয় বছর করা হবে, আর সুদহার হবে ৪ শতাংশ।
দ্বিতীয়ত, এ ক্ষেত্রে মূল অঙ্ক কমবে না, তবে মেয়াদকাল হবে ১৫ বছর, গ্রেস পিরিয়ড থাকবে ৯ বছর। এ সময়ে মূল অঙ্ক পরিশোধ করা হবে না। এসব বন্ডের সুদহার হবে ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
তৃতীয়ত, ডলারভিত্তিক এসএলডিবি বন্ডধারীদের স্থানীয় মুদ্রায় বন্ডে রূপান্তর করে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রেও মূল অঙ্ক কমবে না। বন্ডের মেয়াদ হবে ১০ বছর, আর সুদহার হবে শ্রীলঙ্কা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি রেটের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ ৯৭ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৫১ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারই বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া। এতে জাপান, চীন, ভারত, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে নেওয়া দ্বিপক্ষীয় ঋণের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকে গ্রহণ করা সার্বভৌম ঋণও রয়েছে। আন্তর্জাতিক উৎস থেকে নেওয়া সার্বভৌম ঋণের পরিমাণ ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার এবং দ্বিপক্ষীয় ঋণ ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১৩০ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী মাহিন্দ্রা শ্রীবর্ধনে গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ এই পুনর্গঠনের আওতায় আসবে না, বরং তার নির্দিষ্ট একটি অংশ এর আওতায় আসবে।
এ ছাড়া একবার অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠিত হলে শ্রীলঙ্কা এরপর বিদেশি ঋণ পুনর্গঠনে জোর দেবে। এতে বিদেশি ঋণদাতারাও আস্থায় আসবেন।
শ্রীলঙ্কা সরকার আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ঋণ পুনর্গঠন আলোচনা চূড়ান্ত করতে চায়। এ ক্ষেত্রে আইমএফের শর্ত হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে তারা ঋণ কর্মসূচির প্রথম পর্যালোচনা করবে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা সরকার আইমএফের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঋণ পুনর্গঠন কর্মসূচি এগিয়ে নিতে চায়।
শ্রীলঙ্কা এখন নজিরবিহীন ঋণসংকটের মুখে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ভুল অর্থনৈতিক নীতি, কোভিড মহামারির প্রকোপ, রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত এসব মিলিয়ে দেশটি ২০২২ সালে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকোচন হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বাণিজ্যঘাটতি অবশ্য কিছুটা কমে ৫২০ কোটি ডলারে নামে, যা ২০২১ সালে ছিল ৮১০ কোটি ডলার। সংকট সত্ত্বেও ২০২২ সালে টেক্সটাইল মানে বস্ত্রপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে দেশটির বাণিজ্যঘাটতি কমেছে।
এদিকে শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ২৫ দশমিক ২ শতাংশ, তা জুন মাসে ৫০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশ। আবার জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে, যা মে মাসে ছিল ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময় খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ২৭ থেকে কমে ১৬ দশমিক ২ শতাংশে নামে।
কার কাছে কত ঋণ
পশ্চিমা বিশ্ব বলে আসছে, চীনের কাছ থেকে অবকাঠামোগত ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এটা ঠিক, হামবানটোটা বন্দর নির্মাণে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারেনি দেশটি। সে জন্য এই বন্দরের পরিচালনা চীনের হাতে ছেড়ে দিতে হয়েছে। বাস্তবে শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ চীনের কাছ থেকে নেওয়া। তবে ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ কেবল চীনই নেয়। পশ্চিমা দেশ ও দাতাদের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা তাদের মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কা বাকি ৪৩ শতাংশ ঋণ নিয়েছে অন্যদের কাছ থেকে, যার হিস্যা এ রকম: এডিবি ১৩ শতাংশ, জাপান ১০ শতাংশ, বিশ্বব্যাংক ৯ শতাংশ, ভারত ২ শতাংশ ও অন্যান্য উৎস ৯ শতাংশ।