সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি। মূল্যস্ফীতির এই বাড়তি হারের জন্য কারা দায়ী, সেই অপরাধীদের খোঁজার চেষ্টা চলছে। ইউরোপে বলা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের মুনাফার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
তবে এই ধারণা যুক্তরাষ্ট্রে এসে ধাক্কা খেয়েছে, কারণ সেখানে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা পড়তির দিকে থাকলেও মূল্যস্ফীতি বাড়তি। খবর দ্য ইকোনমিস্টের।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ধারা সত্ত্বেও আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড়ে অর্থাৎ ইউরোপ মহাদেশে করপোরেটদের মুনাফা তত্ত্ব বেশ শিকড় পেয়েছে। আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান বলেছে, মূল্যস্ফীতির অর্ধেক কারণ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা লাগার্দেও এই যুক্তির প্রতি কখনো কখনো সমর্থন জানিয়েছেন।
এদিকে যুক্তরাজ্য সরকার মূল কারসাজির প্রমাণ খুঁজে বের করতে বলেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে। ৩ জুলাই দেশটির প্রতিযোগিতা কমিশন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে বলেছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পেট্রল থেকে অতিরিক্ত মুনাফা করেছে।
করপোরেটদের মুনাফাভিত্তিক এই মূল্যস্ফীতির তত্ত্ব ‘গ্রিডফ্লেশন’ নামে পরিচিত। এটি মূলত মূল্যস্ফীতিবিষয়ক সাধারণ ব্যাখ্যার প্রতিক্রিয়াজাত। সেই সাধারণ ব্যাখ্যাটি এ রকম: ক্রমবর্ধমান মজুরির কারণে মূল্যস্ফীতি হয়।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি গত বছর শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলার আগে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর এ কথায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়, কারণ ২০২১ সাল থেকে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে উন্নত দেশগুলোতে যে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে শ্রমিকদের অবস্থার অবনতি হয়েছে। মজুরির কারণে মূল্যস্ফীতি হয়নি, বরং মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।
তা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলোকে মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হলে কার্য ও কারণ সম্পর্ককে গুলিয়ে ফেলা হয়। মহামারির সময় যে বিপুল প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে। সে সময় দেশটি জিডিপির মোট ২৫ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে, জনগণকে মোট তিন দফায় অর্থের চেক দেওয়া হয়েছে। তখন নীতি সুদহারও কম ছিল। ফলে মানুষ তখন দেদার ব্যয় করেছে; এমনিতেই সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল ভঙ্গুর, মার্কিনদের ব্যয়ের প্রবণতার কারণে অন্যান্য অর্থনীতিও ব্যাহত হয়েছে।
তখন আবার পণ্যের বৈচিত্র্যও ছিল কম, সে কারণে কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফা অনিবার্য ছিল। এরপর রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে খাদ্য ও জ্বালানির স্বল্পতা তৈরি হয়, ফলে এসব কোম্পানি বিপুল মুনাফা করে।
কিন্তু ইউরোপের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত চাহিদা সৃষ্টি হয়নি। ইউরোজোন সম্প্রতি জ্বালানির ভর্তুকি বাবদ জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভর্তুকি দিয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলেও তাদের নীতি সুদহার এখনো অতটা বেশি নয়।
তবে এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যেমন, জ্বালানি ও খাদ্য ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ মুনাফা ও কাজের জন্য জন্য লোক খুঁজে পাওয়া না গেলেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানকার কোম্পানিগুলোর অবস্থাও যুক্তরাষ্ট্রের মতো হবে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফা এ বছর কমবে।
এত কিছুর পরও বলা যায়, কোম্পানিগুলো পণ্যের স্বল্পতার কারণে দাম বাড়াবে—এটা কেবল যৌক্তিক নয়, বরং কাঙ্ক্ষিতও বটে। মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য আনা না গেলে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তখন রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়, অর্থাৎ মানুষকে পণ্যের জন্য লাইন ধরে দাঁড়াতে হবে।
সুবিধাবাদিতা ও প্রতিযোগিতাবিমুখতার নজির থাকলেও তার বাস্তব প্রভাব তেমন একটা অনুভূত হবে না। যুক্তরাজ্যের সুপারমার্কেটগুলো প্রতি লিটার পেট্রলে ৬ পেন্স মুনাফা বাড়িয়েছিল, আজ যে পেট্রলের দাম ১ দশমিক ৪৬ পাউন্ড।
কিন্তু সেটা কখন হয়েছিল, তা দেখতে হবে, তখন জ্বালানির বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল তুঙ্গে—১২৯ শতাংশ। অর্থাৎ ঠিকঠাক হিসাব করা গেলে দেখা যাবে, যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলোর গড় মুনাফা বাড়েনি।
ক্রিস্টিনা লাগার্দে বলেছেন, ইউরোজোনে কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে আসবে, সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তিনি ঠিকই বলেছেন; মুনাফা কমলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে, অর্থনীতিতে শ্রমিকদের হিস্যা পুনরুদ্ধার হবে।
কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে করপোরেটদের লোভের ওপর হামলে পড়তে হবে। বরং এর বদলে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতিপ্রণেতাদের ভুল শোধরাতে হবে। সেটা হলো অতিরিক্ত প্রণোদনার রাশ টানতে নীতি সুদহার বাড়ানো এবং সরকারি ব্যয় হ্রাস বা করহার বাড়ানো।
গত দুই বছরের শিক্ষাটা হলো, কোম্পানিগুলো আরও লোভী হয়েছে, তা নয়, বরং নীতিপ্রণেতারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে দিলে শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে প্রথমে মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে।