এবার ‘এক গ্রাম এক পণ্য’ প্রকল্প, যেসব সুবিধা দেবে সরকার
সব জেলা প্রশাসককে এক মাসের মধ্যে পণ্যের নাম ও উৎপাদনকারীর ঠিকানাসহ প্রতিবেদন পাঠাতে চিঠি দিয়েছেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ।
রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য ১৬ বছর আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) নেওয়া ‘এক জেলা এক পণ্য’ (ওডিওপি) উদ্যোগটি মোটামুটি ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতার কারণ না খুঁজে এবার হাতে নেওয়া হয়েছে ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য (ওভিওপি)’ নামে নতুন উদ্যোগ। এক বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এ উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ উদ্যোগের পর ভবিষ্যতে এ-সংক্রান্ত প্রকল্প নেওয়া হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
পরীক্ষামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে গ্রামওয়ারি পণ্য নির্বাচনের জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) চিঠি দিয়েছেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। ১৩ মার্চ ডিসিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে এক মাসের মধ্যে পণ্যের নাম, উৎপাদনকারীর নাম-ঠিকানাসহ সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক এক বা একাধিক হস্তশিল্পজাত পণ্য বা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকা থাকতে হবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচিটি ইপিবি একভাবে চালিয়ে আসছিল। তাতে কিছু পণ্যও চিহ্নিত হয়েছিল। তবে সেটি খুব ভালোভাবে এগোয়নি। এখন আমরা ডিসিদের কাছ থেকে যে প্রতিবেদন পাব, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে। অন্তত এক বছর আমরা দেখব কোথায়, কী আছে এবং সেগুলোর রপ্তানি সম্ভাবনা কতটুকু।’
এদিকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে সম্ভাবনাময় পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে ‘হস্তশিল্পজাত পণ্য’কে বর্ষপণ্য ঘোষণা করেছেন। বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর ও শ্রমঘন এসব পণ্য উৎপাদনে বেশি পুঁজির দরকার হয় না। তাই প্রতিটি গ্রাম থেকে হস্তশিল্পজাত পণ্য নির্বাচন করতে হবে, যার মধ্যে খাদ্যজাত পণ্যও থাকতে পারে।
নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
ঝালকাঠির ডিসি ফারাহ্ গুল নিঝুম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারার বাজার এ জেলায়। বরিশালের মিষ্টি আমড়া বলতে যা বোঝানো হয়, তার ৮০ শতাংশই ঝালকাঠির। এ ছাড়া শীতলপাটি, সুপারি এবং হাতেভাজা একধরনের মুড়ি রয়েছে ঝালকাঠিতে, যা অন্য সব জেলা থেকে আলাদা। এগুলো নিয়ে তিনি যথাসময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন।
সরকার যেসব সুবিধা দেবে
ডিসিদের কাছ থেকে তালিকা পেলে তা থেকে দেশসেরা পণ্য নির্বাচন করবে সরকার। ভবিষ্যতে সেগুলোর ব্র্যান্ডিংও করা হবে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ দেশে–বিদেশে বিভিন্ন মেলায় এসব পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ছাড়া এসব পণ্য উৎপাদনে স্বল্প সুদে, বিনা সুদে বা বিনা জামানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।
এর বাইরে আগামী মাসে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব মেলা হবে, সেগুলোতে হস্তশিল্পজাত পণ্যের বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয়, সে জন্য ডিসিদের অনুরোধ জানানো হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে।
জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, বাণিজ্যসচিবের চিঠি তিনি পেয়েছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছেন। শিদল বা চ্যাপা শুঁটকি, রাতাবোরো চাল এবং পনির—আপাতত এ তিন পণ্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ওভিওপি ধারণার উদ্ভাবক জাপান
জাপান সরকার আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১৯৭৯ সালে প্রথম ওভিওপিকে আন্দোলন আকারে শুরু করে। এ আন্দোলনের জনক দেশটির একটি অঞ্চলের তৎকালীন গভর্নর মরিহিকো হিরামাৎসু। ১৯৮০ সাল থেকে এ আন্দোলনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করে দেশটি। তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রাম থেকে উচ্চ মূল্য সংযোজনের ৩০০ পণ্য চিহ্নিত করে জাপান।
জাপানের এ আন্দোলন পরে কিরগিজস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। ওভিওপি কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরির সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে সহযোগিতায় আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
ওডিওপি থেকে ১৪ পণ্য চিহ্নিত
২০০৮ সালে এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি হাতে নেয় বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এ কর্মসূচি চালু করে। আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইপিবিকে।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এক জেলা এক পণ্য বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি ছিল না। ইপিবি চেষ্টা করেছে এর মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য কিছু পণ্য বের করে আনতে। তার আওতায় আগর, সুগন্ধি চাল, হস্তশিল্প কিছু রপ্তানিও হয়েছে। এখন যেভাবে একটি গ্রাম একটি পণ্যের কথা চিন্তা করা হচ্ছে, তা রপ্তানি পণ্য বাড়াতে কাজে দেবে বলে আশা করা যায়।
এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচির আওতায় ৪১টি জেলা থেকে ১৪টি পণ্য নির্বাচন করা হয়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজারে আগরউড ও আগরবাতি; নাটোরের ভেষজ উদ্ভিদ; পঞ্চগড়ের অর্গানিক চা; দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার সরু ও সুগন্ধি চাল; খুলনার কাঁকড়া; বান্দরবানের রবার; সুনামগঞ্জ, ফেনী, জামালপুর, ফরিদপুর, রংপুর ও কুড়িগ্রামের হস্তশিল্প; রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও রাঙামাটির হস্তচালিত তাঁতবস্ত্র; দিনাজপুরের পাঁপড়; জয়পুরহাট, চাঁদপুর, বগুড়া, নীলফামারী, মুন্সিগঞ্জ, মেহেরপুর, যশোর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ঝিনাইদহ ও নারায়ণগঞ্জের তাজা শাকসবজি; নেত্রকোনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও নড়াইলের মাছ; চট্টগ্রামের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; খাগড়াছড়ির আনারস এবং চুয়াডাঙ্গার পান।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি থেকে কেন সুফল পাওয়া গেল না, আগে তার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। আর নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল মিলতে পারে।