সুন্দরবনে পর্যটক বাড়াল পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু চালুর পর দেশি পর্যটক বেড়েছে ৪৫%।
গত এক বছরে বিদেশি পর্যটক দ্বিগুণ হয়েছে।
সুন্দরবন পর্যটনে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হচ্ছে।
ফেরদৌস ইফতেখার রাজধানীর একজন ব্যবসায়ী। আয়রোজগার ভালোই। তাই সময় পেলেই দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু যাতায়াতে ঝক্কি-ঝামেলার কারণে আগে কখনো সুন্দরবন যাওয়া হয়নি তাঁর। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় তিনি আগামী সপ্তাহে সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন, তা-ও আবার সপরিবার। তিনি ইতিমধ্যে দুই রাত ও তিন দিনের একটি প্যাকেজের বুকিং দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ফেরদৌস ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কপথে খুলনা যেতে আগে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা লাগত। এত সময় লাগে বলে সুন্দরবন যাওয়া হয়নি। এখন রাত ১২টায় বাসে উঠব, সকালে খুলনা নেমে সরাসরি জাহাজে গিয়ে ফ্রেশ হব। তারপর তিন দিন জাহাজে করে সুন্দরবন ঘুরব।’
শুধু ফেরদৌস ইফতেখার নন, তাঁর মতো আরও অনেকেই এখন সুন্দরবন ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পদ্মা সেতুর কল্যাণে খুলনা এখন যেন ঘরের কাছের শহর হয়ে গেছে।
২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বদৌলতে গত এক বছরে সুন্দরবন ভ্রমণে দেশি পর্যটক বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। আর বিদেশি পর্যটক বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। পর্যটকবাহী বিলাসবহুল ভ্রমণতরির সংখ্যাও বেড়েছে। এ খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে।
কক্সবাজারের হোটেল ও পর্যটন ব্যবসার প্রতিষ্ঠান সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড দুই বছর আগে সুন্দরবনে ট্যুর মানে ভ্রমণ আয়োজনে যুক্ত হয়। সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য এখন সবচেয়ে বিলাসবহুল দুটি ভ্রমণতরি রয়েছে তাদের।
এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার খুলনার তত্ত্বাবধায়ক এস এম মুসফিকুর হাসান। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটকের চাপ বাড়বে, এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ভ্রমণতরি নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। দুটি জাহাজ দিয়ে গত বছর থেকে ট্যুর কার্যক্রম চালু করা হয়। শুরু থেকেই ব্যস্ত সময় কেটেছে জাহাজ দুটির। পর্যটন মৌসুমে প্রতি সপ্তাহেই দুটির বেশি ট্যুর করা গেছে।
সি পার্ল কোম্পানির জাহাজে গেলে জনপ্রতি খরচ পড়ে ১১ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা। বিদেশিদের ক্ষেত্রে বনে ভ্রমণের অনুমতির জন্য বাড়তি সাড়ে সাত হাজার টাকা মাশুল বাবদ নিতে হয়।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সুন্দরবন ভ্রমণে আগ্রহ বাড়ছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। ফলে প্যাকেজে সুন্দরবনে ভ্রমণ আয়োজনের ব্যবসা জমে উঠেছে।
জানা গেছে, বেশির ভাগ জাহাজ খুলনা থেকেই যাত্রী নিয়ে সুন্দরবনের দিকে যায়। বাগেরহাটের মোংলা এলাকা থেকেও বেশ কিছু জাহাজ যায়। এদিকে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনে ভ্রমণতরি বা ক্রুজ জাহাজ নামানোর পরিকল্পনা করছে।
সুন্দরবনে ভ্রমণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন সূত্রে জানা গেছে, অনেক ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের সুন্দরবনে পর্যটন প্যাকেজ আছে। বর্তমানে সংগঠনটির সদস্যসংখ্যা ৪৮। ওই সব অপারেটরের নৌযান রয়েছে ৫৭টি, এর মধ্যে ২০টিই বিলাসবহুল। গত দুই বছরে ৫টির বেশি বিলাসবহুল জাহাজ যুক্ত হয়েছে। এ বছর আরও অন্তত ১৫টি বিলাসবহুল জাহাজ যুক্ত হবে।
এসব জাহাজে তিন দিনের প্যাকেজ জনপ্রতি সাড়ে সাত হাজার টাকা থেকে শুরু হয়। প্যাকেজের আওতায় কেবিন, খাওয়া, বনে ভ্রমণ—সবই অন্তর্ভুক্ত।
খুলনা থেকে সকাল সাতটা-আটটার মধ্যেই জাহাজগুলো সুন্দরবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। দুপুরের মধ্যে পশুর নদ দিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে ঢুকে পড়ে এসব জাহাজ। সুন্দরবন ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হলো ক্যানেল ক্রুজিং। অর্থাৎ সুন্দরবনের ভেতরে ছোট ছোট খালে ছোট নৌকায় করে ভ্রমণ। এতে পর্যটকেরা সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে বাঘ মামার দেখাও পেয়ে যান কেউ কেউ।
সুন্দরবন ভ্রমণের জনপ্রিয় রুট হলো খুলনা-হাড়বাড়িয়া, কচিখালী-কটকা-করমজল-খুলনা।
সম্প্রতি সরেজমিনে মোংলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফেরিঘাটের আশপাশে বেশ কিছু অপারেটর রয়েছে। পর্যটক দেখলেই হাঁকডাক শুরু করেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। তাঁরা মূলত সুন্দরবনে এক দিনের ভ্রমণ প্যাকেজ অফার করেন। করমজল এলাকা পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনেন তাঁরা।
জানতে চাইলে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আজম বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ার পর সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। বেশি বেড়েছে মোংলা থেকে এক দিনে ঘুরে আসা যায় এমন গন্তব্য, অর্থাৎ করমজল ও হাড়বাড়িয়া স্পটের পর্যটক। সবচেয়ে আশার কথা হলো, কয়েক বছর ধরে কমলেও গত বছর থেকে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
বিদেশি পর্যটক দ্বিগুণ, দেশি বেড়েছে ৪৫%
সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন গত এক বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর। দেশি পর্যটকও বেড়েছে অনেক। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৯০ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলেন। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক ছিলেন মাত্র ৩৯০ জন। পরের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্রমণ করেন মোট ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৫ জন পর্যটক। তাতে বিদেশি পর্যটক ছিলেন ১ হাজার ১০৩ জন।
২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশি পর্যটক ৪৫ শতাংশ এবং বিদেশি পর্যটক বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ২৭৪ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। এ সময়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন মোট ২ লাখ ১৭ হাজার ১৬৯ জন পর্যটক।
এদিকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে, এমন চিন্তাভাবনা থেকেই সুন্দরবনে নতুন করে চারটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বনের জীববৈচিত্র্য ও সার্বিক পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে এই কেন্দ্রগুলো করা হয়েছে। এতে পর্যটকেরা এক জায়গায় ভিড় না করে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সুন্দরবন দেখার সুযোগ পাবেন বলে জানান সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আবদুল হারুন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনে পর্যটক বেড়েছে। এটি অবশ্যই এই অঞ্চলের অর্থনীতি তথা ব্যবসার জন্য ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যাঁরা সুন্দরবনে পর্যটক হিসেবে যান, তাঁরা সেখানকার প্রতিবেশ রক্ষার সাধারণ নিয়মগুলো মানেন না। এটি বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’
আবদুল হারুন চৌধুরী আরও বলেন, ‘পর্যটকেরা প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিনের প্যাকেট যত্রতত্র ফেলে আসেন। কটকা, কচিখালী—এসব পয়েন্টে স্তূপ আকারে জমে প্রায় দ্বীপের মতো হয়ে গেছে, যা সেখানকার বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া পর্যটকেরা উচ্চ শব্দে গান বাজান। এসব তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের কোনো উদ্যোগ দেখি না। পর্যটক বৃদ্ধি মানে বনের ক্ষতিও বৃদ্ধি পায়। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত বনের মধ্যে টহল বসানো এবং পর্যটকদের এসব কাজে নিবৃত্ত রাখা।’