অর্থনীতি
ডলারের দর প্রকল্পের ব্যয় বাড়াচ্ছে
ডলারের অভাবে বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে। প্রকল্পের খরচ বাড়ছে।
ডলার–সংকটে পড়েছে দেশের বড় বড় প্রকল্প। ডলারের অভাবে প্রকল্পের বিদেশি ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পিছিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন। এ প্রকল্পের তালিকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের মতো প্রকল্পও আছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বহু প্রকল্পের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। সংশোধন করা হচ্ছে একাধিক প্রকল্প।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু দিয়ে গত বছর যান চলাচল শুরু হয়েছে। সেতুর ওপর দিয়ে এখন রেল সংযোগের কাজ চলছে। চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। চলতি অর্থবছরে ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, ৭৫ শতাংশ অর্থ ডলারে এবং বাকি ২৫ শতাংশ টাকায় পরিশোধ করতে হয়। প্রতি মাসে খরচ কত হলো, এর ওপর ভিত্তি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল বা ইনভয়েসের মাধ্যমে এই অর্থ পরিশোধ করা হয়।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চার মাস ধরে ঠিকাদারের প্রতি মাসের ইনভয়েসের (ডলার অংশ) পুরোটা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। গত চার মাসে প্রতি মাসে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ডলারের ইনভয়েস (বিল) দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অর্ধেকের মতো বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ঠিকাদারকে পুরো অর্থ পরিশোধের জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্প কার্যালয় থেকে একাধিকবার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে এখনো আরও ৫ কোটি ডলারের মতো অর্থ পরিশোধ করতে হবে বলে জানা গেছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদারের চাহিদা অনুসারে ডলারে বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বাকি পড়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুম বলে এত দিন কম কাজ হয়েছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে বেশি কাজ হবে। আগামী কয়েক মাস ঠিকাদারের মাসওয়ারি বিল আরও বাড়বে।
সরকারের অগ্রাধিকারের আরেক প্রকল্প হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (১ম পর্যায়) বা তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। জাপানের মিতসুবিশি করপোরেশন, ফুজিতা ও দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদার স্যামসাংয়ের নেতৃত্বাধীন এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামকে কাজ দেওয়া হয়েছে। ইয়েন ও টাকায় অর্থ পরিশোধ করা হয়। এখানে ডলারের সমস্যা নেই। কিন্তু ঠিকাদারকে রড, গ্লাস, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। এসব পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হচ্ছে বলে প্রকল্প কার্যালয়কে জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টার্মিনালের মূল ভবনের কাজ শেষের দিকে। এখন টার্মিনালের ছাদ নির্মাণ ও দেয়ালের গ্লাস বসানোর কাজ চলছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কনভেয়ার ভেল্ট, দরজা, বোর্ডিং ব্রিজ, চলন্ত সিঁড়ি ও পথ ইত্যাদি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হবে। এসব যন্ত্রপাতি আমদানি করতে বিপুল পরিমাণ ডলার প্রয়োজন হবে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই ডলার–সংকটের সময়ে ঠিকাদার এসব পণ্যের ঋণপত্র খুলতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রাথমিকভাবে টার্মিনালের উদ্বোধনের সময় ঠিক করা হয়েছে। ঠিকাদার যথাসময়ে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে না পারলে, তা পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
ডলার–সংকটের কারণে এ বছরের শুরুতে বিদ্যুৎ খাতের কয়েকটি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির বিপরীতে ঋণপত্রের বিল প্রায় দুই মাস আটকে ছিল ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। অর্থের পরিমাণ সাড়ে ১২ লাখ ডলার ও ১৪ লাখ ইউরো। পরে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়।
এমন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ডলার–সংকটে ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। আবার আমদানি করে জিনিসপত্র আনায় এলসি খোলাতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঠিকাদারকে। এ তালিকায় আছে রাজধানীতে মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা বহুমুখী সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলার–সংকটের কারণে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করতে না–পারা কিংবা এলসি খুলতে না–পারার বিদেশিদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পে স্বনামধন্য বিদেশি ঠিকাদারেরা কাজ করেন। বিল পরিশোধে বিলম্ব হতে হতে একসময় তা খেলাপিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কা থাকে। তখন আরও বিপদ। তাই এ অবস্থা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে। ডলারের জোগান বাড়াতে হবে। তিনি মনে করেন, ডলারের সংকট এখন অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে পড়ছে। বড় প্রকল্পে কাজের গতি কমে গেলে তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এক প্রকল্পেই খরচ বেড়েছে ১৫৬ কোটি টাকা
২০২১ সালে জানুয়ারি মাসে ৬৯৩ কোটি টাকার তৃতীয় সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের সিংহভাগ পণ্যই আমদানি করতে হবে। এমনকি পরামর্শক সেবাও বিদেশ থেকে নিতে হবে। দুই বছর আগে যখন প্রকল্পটি নেওয়া হয়, তখন প্রতি ডলারের হিসাব করা হয় ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা ধরে। কিন্তু এখন ডলারের ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা। এতে বাকি কাজ করতে ১৫৬ কোটি ডলার বাড়তি লাগবে। এই হিসাব দিয়ে গত মাসে প্রকল্পটি সংশোধন করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
২২ নভেম্বর প্রকল্পটি সংশোধন করে অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ৩৫০ কোটি টাকা খরচ ও এক বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়। বাড়তি খরচের অর্ধেকই ডলারের বাড়তি দাম সমন্বয়ের জন্য।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের খরচও প্রভাব পড়ছে। বাড়তি খরচ মেটাতে প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব চলতি মাসেই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। খরচ বাড়ানো হচ্ছে ২ হাজার কোটি টাকা। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়তি ২৫০ কোটি টাকা লাগবে। এই বিষয়টিও সমন্বয় করা হয়েছে। মূল প্রকল্পের খরচ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। প্রায় ৮৭ শতাংশের মতো খরচ হয়ে গেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানা গেছে, বর্তমানে অর্ধশতাধিক প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব এসেছে। ২০-২৫টি প্রকল্পের প্রস্তাবে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সমন্বয় করে বাড়তি খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমদানিনির্ভর ও বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পই বেশি।
২০-২৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়
অর্থনৈতিক চাপের কারণে বহু প্রকল্পের খরচে লাগাম টানা হয়েছে। চলতি প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমিয়ে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পে বিদেশ সফর বন্ধ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ কাটছাঁট করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে এসি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা; গাড়িতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো, যথাসম্ভব জুমে বৈঠক করা ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এসব উদ্যোগের ফলে চলতি অর্থবছরে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে।
কিন্তু মাঠের তথ্য তা বলছে না। চলতি অর্থবছরে সাতটি একনেক সভায় অর্ধশতাধিক প্রকল্প পাস করা হয়েছে। পাস হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে ৪৪টি প্রকল্পের অনুমোদন ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এই ছাড়পত্রের মানে হলো, এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দে আর কোনো বাধা নেই। ওই ৪৪টি প্রকল্পের মধ্যে ২৯টি প্রকল্পই নতুন। এসব প্রকল্পের মধ্যে হোস্টেল নির্মাণ, রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খাল সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আধুনিক করা; বিভাগীয় ও পৌরসভায় ভবন নির্মাণের মতো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আছে।
তবে আগের মতো প্রতি সপ্তাহে একনেক সভা এখন হয় না। কয়েক মাস ধরে এখন প্রতি দুই সপ্তাহ বা তিন সপ্তাহে একটি একনেক সভা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একনেক বিভাগে আগে সব সময় একসঙ্গে ১৫-২০টি প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে উত্থাপনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে থাকত। এখন ৪-৫টি প্রকল্প আছে।
বর্তমানে এডিপিতে ১ হাজার ৩৬৩টি প্রকল্প আছে। অর্থনীতির এই চাপের সময়ে সরকার সম্প্রতি এই প্রকল্পগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণিতে ভাগ করেছে। ‘এ’ শ্রেণির প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মানে, চলতি এডিপিতে যা বরাদ্দ আছে, তা পুরোটাই খরচ করবে। বি শ্রেণিতে থাকা প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ (দেশজ উৎসের অর্থ) ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। ‘সি’ শ্রেণির প্রকল্পকে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হবে। ৬৪৬টি প্রকল্প ‘এ’ শ্রেণিতে, ৬৩৬টি প্রকল্প ‘বি’ শ্রেণিতে এবং ৮১টি প্রকল্প ‘সি’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। বাকি ৯টি প্রকল্প কোনো শ্রেণিতে রাখা হয়নি।