সিগারেট ফুঁকে এক বছরে ৩৮ হাজার কোটি টাকা কর দিয়েছেন ধূমপায়ীরা

এ দেশের ধূমপায়ীরা সিগারেট ফুঁকে বছরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর দেন। প্রতিটি শলাকার দামের ৬০-৮০ শতাংশই তাঁদের শুল্ক-কর হিসেবে দিতে হয়।

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে সব মিলিয়ে ৩৭ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। ৩১টি কোম্পানি সিগারেট বিক্রির বিপরীতে সরকারকে এই শুল্ক-কর দিয়েছে, যা মূলত ধূমপায়ীদের পকেট থেকেই যায়। সিগারেটের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ। এই বিভাগের গত অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে শুল্ক-কর আদায়ের চিত্রটি পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিগারেট হচ্ছে এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত। সংস্থাটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে পুরো সিগারেটের বাজারের আকার ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সিংহভাগই রয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) দখলে।

২০২৩ সালে বিএটিবি ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের সিগারেট ও তামাকজাতীয় পণ্য বিক্রি করেছে। এতে তাদের প্রায় ৭ হাজার ১২৩ কোটি ৯০ লাখ শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই সরকার সিগারেট খাতের ৮০ শতাংশের বেশি রাজস্ব পায়।

আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিগুলোর সিগারেট বিক্রির বিপরীতে ৩২ হাজার ৮১৬ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় করেছিল ভ্যাট বিভাগ। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ব্যান্ডরোল থাকে। কারণ, কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানকে প্যাকেটের গায়ে ব্যান্ডরোল লাগিয়ে বাজারজাত করতে হয়। ব্যান্ডরোল বিক্রির মাধ্যমেই সরকার সিগারেট থেকে রাজস্ব আদায় করে থাকে।

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ধূমপায়ীর সংখ্যা ৩৯ শতাংশের মতো।

তামাকবিরোধী প্রচারণা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা বলেছে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর দেশে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ ভ্যাট আহরণের শীর্ষ ১০টি খাত বিশ্লেষণ করে দেখেছে, দেশে গত অর্থবছরে মোট যে পরিমাণ ভ্যাট আদায় হয়েছে, এর ৫৯ শতাংশই এসেছে পাঁচটি খাত থেকে। এই অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭১৮ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি খাত থেকেই এসেছে ৮৮ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। সিগারেট ছাড়া তালিকায় বাকি চার খাত হলো, ঠিকাদার, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, তেল-গ্যাস কোম্পানি ও মোবাইল ফোন কোম্পানি।

অন্য চার খাতের অবস্থা

ভ্যাট আদায়ে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে আছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দেশের ২৫ হাজার ৩০৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছরে ১৬ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধের সময় ভ্যাট কেটে রাখা হয়।

২৫ হাজার ৭৭২টি নিবন্ধিত নির্মাণসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছরে ১২ হাজার ১৩১ কোটি টাকার ভ্যাট এসেছে। ছয়টি তেল-গ্যাস কোম্পানি ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা দিয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন খাত থেকে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা এসেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগের সদস্য মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছরের মধ্যে গত অর্থবছরে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ রাজস্ব আদায়ে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ড করেছে। গত মে থেকে জুনে প্রচেষ্টানির্ভর বিশেষ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ভ্যাট আদায় বাড়ানো হয়েছে। এনবিআরের তিন বিভাগের মধ্যে ভ্যাট বিভাগই কেবল লক্ষ্য ছুঁই ছুঁই করছে।

মইনুল খান মনে করেন, ‘গত কয়েক দিনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে ভ্যাট আদায়ে কিছুটা চাপ পড়েছে। তবে বাড়তি চেষ্টা করে আমরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেব।’

কত আদায় হলো

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। এটি সাময়িক হিসাব। সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। সেই হিসাবে, রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্য থেকে ৪৭ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা ও সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ২৭ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে।

অর্থাৎ এনবিআরের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাড়তি রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য দিয়েছিল, তা সংস্থাটি অর্জন করতে পারেনি। নিয়মিত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জিডিপির প্রায় আধা শতাংশের সমান বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত দেয় আইএমএফ।

এনবিআরের সাময়িক হিসাবে দেখা যায়, গত অর্থবছরে আয়কর ও ভ্রমণকর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি হয় ১৬ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮১৯ কোটি টাকা, আর লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ঘাটতি হয়েছে ৯ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা।

তবে ভালো করেছে ভ্যাট খাত। ১ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা।