বঙ্গবাজার
ব্যবসায় ফিরতে পারেননি হাজারো ব্যবসায়ী
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ মূলধন-সংকটে আছে। সহায়তাও মিলছে না। যাঁরা ব্যবসায় ফিরেছেন, তাঁদেরও অনেকে ঋণভারে জর্জরিত।
আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়ার পর ঢাকার বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় ব্যবসায়ীদের পোড়া মার্কেটের জায়গায় অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো প্রায় এক হাজার ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। এসব ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে ঋণগ্রস্ত হওয়ায় এবং নতুন করে মূলধন না পাওয়ায় ব্যবসায় ফিরতে পারছেন না। আর যাঁরা ব্যবসায় ফিরেছেন, তাঁরাও এখনো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেননি।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের যে চার ইউনিট আগুনে পুড়ে গেছে, তার মধ্যে মহানগরী ও আদর্শ মার্কেটের দুই ইউনিটের আট শতাধিক ব্যবসায়ী এখনো তাঁদের ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। এসব ব্যবসায়ীর জন্য বরাদ্দ করা চৌকি এখনো খালি পড়ে আছে। কারণ, নতুন করে পুঁজি জোগাড় করতে না পারায় এবং কোনো আর্থিক সহায়তা অথবা ঋণ না পাওয়ায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না। অন্যদিকে বঙ্গবাজার ও গুলিস্তান ইউনিটের ব্যবসায়ীদের বড় অংশই অস্থায়ী চৌকিতে দোকান নিয়ে বসেছে। তবে এই দুই ইউনিটেরও দেড় শ থেকে দুই শ ব্যবসায়ী এখনো ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। ফলে সব মিলিয়ে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের প্রায় এক হাজার ব্যবসায়ী এখনো তাঁদের ব্যবসা থেকে ছিটকে রয়েছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কর্মচারীরাও আছেন কষ্টে। বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য যে অর্থ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে, সেগুলো দ্রুত বিতরণ করা হলে কেউ কেউ হয়তো তাতে ব্যবসায় ফেরার সুযোগ পাবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ) মোট দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১। অগ্নিকাণ্ড এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এখন ওই সব দোকানের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। সব মিলিয়ে বঙ্গবাজারে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের।
বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত যেসব ব্যবসায়ী এখনো ব্যবসায় ফিরতে পারেননি, তাঁরা মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী। তাঁদের একেকজনের বিনিয়োগ ছিল ২ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত। তাঁদের বড় অংশই খুচরা ব্যবসায়ী। দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতেন তাঁরা। গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে মালপত্র পুড়ে যাওয়ায় বঙ্গবাজারের এসব ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। আগুনে অনেকের নগদ টাকাও পুড়ে গেছে। ফলে পুঁজির অভাবে তাঁদের ব্যবসায় ফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তাঁদেরই একজন মুয়াজ গার্মেন্টসের মালিক রকিবুল কাইয়ূম। তিনি মুঠোফোনে সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব হারিয়ে এখন লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছি, যাতে ব্যবসাটা চালু করতে পারি।’
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশই এখন মূলধন-সংকটের পাশাপাশি ঋণগ্রস্তও। ঋণের টাকার সুদ দিতে না পেরে তাঁদের অনেকে ব্যবসা ছেড়েছেন। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। বড়রা ঋণের চাপ সামাল দিতে পারলেও ছোটরা পারছেন না।
ঋণগ্রস্ত ব্যবসায়ী মায়ের দোয়া গার্মেন্টসের নিয়ামত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নানাভাবে ধারদেনা করে কিছু ঋণ শোধ করার পরও
এখনো তিন লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। নিজের জমানো টাকা যা ছিল, তা আগেই শেষ। তাই এখন ব্যবসায় পুঁজি খাটাতে হিমশিম খাচ্ছি। অথচ প্রতি মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় স্ত্রীকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। ব্যবসাটা ভালোভাবে চালু করা যায় কি না, সেই চেষ্টায় আছি এখন।’
এদিকে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে করা মামলায় অনেক ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। মামলার কারণেও অনেকে বঙ্গবাজারে ব্যবসায় ফিরতে পারছেন না বলে দাবি করেছেন।
সব হারিয়ে এখন লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছি, যাতে ব্যবসাটা চালু করতে পারি।
এ ছাড়া আগুনের ঘটনার পর আগের মতো এখন আর ক্রেতাও মিলছে না বঙ্গবাজারে। তাই যাঁরা ব্যবসায় ফিরেছেন, তাঁদের ব্যবসাও তেমন ভালো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতিও ফিরে আসেনি বলে দাবি তাঁদের। এখন তাঁরা আসন্ন শীতকালীন ব্যবসায় ভালো করার আশায় আছেন। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের একটি অংশের ধারণা, শীতকাল পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারলে কিছুটা ক্ষতি হয়তো পোষানো যাবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ায় অনেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ এখনো ব্যবসায় ফিরতে পারেনি। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কর্মচারীরাও আছেন কষ্টে। বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য যে অর্থ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে, সেগুলো দ্রুত বিতরণ করা হলে কেউ কেউ হয়তো তাতে ব্যবসায় ফেরার সুযোগ পাবেন।
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর গঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবাজারে সব মিলিয়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।