সোনার রেকর্ড দামে ঈদেও কর্মহীন পাবনার স্বর্ণকারেরা

পাবনার বেড়া উপজেলার স্বর্ণকারদের কাছে রমজান ও ঈদুল ফিতরের সময় এক-দেড় মাস ব্যস্ত থাকার মৌসুম। এই সময়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাঁরা স্বর্ণালংকার বানিয়ে অন্য সময়ে চেয়ে বাড়তি আয় করে থাকেন। সেই আয়ে বছরের বেশ কয়েক মাস স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন। কিন্তু এবারের ঈদ তাঁদের আয়ে মন্দা চলছে। যে সময়ে তাঁদের নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজে ব্যস্ত থাকার কথা, সেই সময়ে তাঁদের বেশির ভাগই হয়ে রয়েছেন কর্মহীন। বছরের সবচেয়ে ভরা মৌসুমে বেকার হয়ে বসে থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁরা।

স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীরা জানান, প্রায় প্রতি মাসেই স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। বেড়া উপজেলায় প্রতি ভরি পাকা স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। এর আগে কখনো স্বর্ণের এত দাম দেখা যায়নি। ‘আকাশছোঁয়া’ এই দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। এর আগে ঈদ উপলক্ষে অনেকেই শখ করে স্বর্ণালংকার তৈরি করতে দিতেন। এবার তাঁদের স্বর্ণালংকার বানাতে কেউ তেমন একটা আসছেন না।

স্বর্ণালংকার তৈরি করতে না আসার পেছনে আরও কারণ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। এবার পেঁয়াজ, আলুসহ সবজি আবাদ করে কৃষকদের অনেকেই লোকসানের মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে দেশের অন্যতম পেঁয়াজ চাষাবাদের এলাকা হওয়ায় অন্যান্য বছরে বেড়ার কৃষকেরা পেঁয়াজ ওঠার পর তা বাজারে বিক্রি করে স্ত্রী-মেয়েসহ স্বজনদের জন্য গয়না তৈরি করেন। তাঁদের মতে, স্বর্ণালংকার একধরনের স্থায়ী সম্পদের মতো, বিপদে কাজে লাগে। কিন্তু এবার লাভ তো দূরের কথা, কৃষকের উৎপাদন খরচই উঠছে না। তাই বেশির ভাগ কৃষকই এবারের ঈদে গয়না তৈরিতে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এমনকি বিয়েতেও এখন স্বর্ণালংকার ব্যবহার একেবারে কমে গেছে।

স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীরা জানান, ছয় থেকে সাত মাস আগেও প্রতি ভরি পাকা স্বর্ণের দাম এক লাখ টাকার মধ্যে ছিল। তখনই এই দাম ছিল সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন দাম বাড়তে বাড়তে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

সরেজমিনে বেড়া বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজারের স্বর্ণালংকার তৈরির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ দোকানেই তেমন কোনো কাজ নেই। স্বর্ণালংকার তৈরির কারিগরেরা বেকার বসে আছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি দোকানের মালিক ও কারিগরদের এই ভরা মৌসুমেও দোকান ছেড়ে দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বেড়া বাজারের স্বর্ণকার বিশ্বজিৎ কুমার বলেন, ‘বেড়া বাজারে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে স্বর্ণালংকার তৈরির কাজ করতাম। অথচ দীর্ঘদিন ধরে তেমন কাজ (গয়না তৈরি) পাচ্ছি না। এ অবস্থায় সংসার চালানো, দোকান ভাড়া—এসব খরচ মেটানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে এই মাস থেকে দোকানটা ছাইড়্যা দিছি।’

বেড়া উপজেলায় দুই শতাধিক স্বর্ণালংকার তৈরির দোকান রয়েছে। এসব দোকানে এক হাজারের বেশি স্বর্ণকার কাজ করেন। চাহিদা থাকলে গয়নার দোকানের মালিকেরা স্বর্ণকারদের কাছে স্বর্ণালংকার তৈরি করতে দেন। স্বর্ণালংকারের স্বাভাবিক চাহিদা থাকলে স্বর্ণকাররা প্রতিদিন ছয় থেকে সাত শ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। এমন আয়ে এমনিতেই তাঁদের ভালোমতো সংসার চলে না। এ মৌসুমে বেকার হয়ে পড়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁরা।

বেড়া বাজারের স্বর্ণকার রিপন কর্মকার বলেন, ‘স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীরা আমাগরে দিয়ে কাজ করান। কিন্তু এবারের ঈদে আমরা তেমন কাজের অর্ডার পাচ্ছি না। নানা পেশাজীবীর মধ্যে আমরাই এখন সবচেয়ে কষ্টে আছি। আমাগরে মধ্যে অনেকে ঠিকমতো বাজারও করতে পারে না।’

‘স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীসহ স্বর্ণকারদের এমন দুঃসময় আর কখনো আসেনি। অথচ ঈদের এই মৌসুমের জন্যই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। যেখানে আমাদের বাড়তি আয় করার কথা সেখানে উল্টো স্বর্ণালংকারের দোকান ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ এমন মন্তব্য করেন বেড়া উপজেলা স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গৌর কর্মকার।