অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত
বাজারদরেই হবে জমির দলিল
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে এ বিষয়ে একটি পদ্ধতি বের করার দায়িত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
জমি কেনাবেচায় মৌজা দরপদ্ধতি আর থাকছে না। এর বদলে যে দামে জমি কেনাবেচা হয়, সে দামেই হবে জমির নিবন্ধন বা দলিল। বাজারমূল্যে জমির কেনাবেচার বিষয়ে একটি কার্যকর পদ্ধতি বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান। অনলাইন মাধ্যমে গত ২৯ আগস্ট বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহকে নতুন পদ্ধতিটি নির্ণয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কাজটি করবেন ভূমি মন্ত্রণালয়; নিবন্ধন অধিদপ্তর; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমন্বয়ে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, সেদিন অর্থমন্ত্রী বলেন, উচ্চ মূল্যের জমি অনেক কম মূল্যে দেখানোয় বিপুল পরিমাণ বৈধ অর্থ অবৈধ হয়, যা কিনা পরে বিদেশে পাচারও হয়। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনেক বৈঠক করলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার করে আনার চেয়ে পাচার রোধ করা ভালো। জমি নিবন্ধন বাজারভিত্তিক হলে মানি লন্ডারিং বা মুদ্রা পাচার কমে আসবে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, জমি নিবন্ধনের সময় প্রকৃত মূল্য না দেখানোর কারণে অনেক সময় বৈধ অর্থ অবৈধ হয়ে যায়। বাজারভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
* জমি নিবন্ধনে বর্তমানে জমির ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি দেড় শতাংশ, নিবন্ধন মাশুল ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ৩ শতাংশ এবং এলাকাভেদে ১ থেকে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হয়। * কোনো প্রতিষ্ঠানের জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচা হলে যোগ হয় আরও ৪ শতাংশ উৎসে কর।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্ব পেলেও তিনি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো বৈঠক ডাকেননি, তবে শিগগির সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
বর্তমানে মৌজা দর (রেট) অনুযায়ী জমি কেনাবেচা বা নিবন্ধন করা হয়। মৌজা দর মানে হচ্ছে সর্বনিম্ন দর, অর্থাৎ মৌজা দরের চেয়ে কম দাম দেখিয়ে কেউ জমি কেনাবেচা করতে পারবেন না। মৌজা দর নির্ধারণের কাজটি হয় ‘সর্বনিম্ন বাজারমূল্য বিধিমালা’ অনুযায়ী। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌজা দর সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ২০১৬ সালে, এখনো সেই দরে নিবন্ধন চলছে।
বিধিমালা অনুযায়ী, বাজারমূল্য নির্ধারণ করে একটি কমিটি। কমিটির মাধ্যমে দুই বছর পরপর বাজারমূল্য হালনাগাদ করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে (২২ মাস) দলিলে উল্লেখ করা দামের গড় করে নতুন দর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। পরে এর ভিত্তিতে মৌজা দর চূড়ান্ত করেন ভূমি নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক।
নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার গুলশান সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অধীন মৌজা আছে ১৪টি। এ ১৪ মৌজায় ৮ ধরনের জমি আছে। মৌজা দর অনুযায়ী ধরনভেদে এ এলাকার ১ শতাংশ জমির দাম ১ লাখ থেকে ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু গুলশানের কোথাও কোটি টাকার নিচে ১ শতাংশ জমি কেনাবেচা হয় না। ধানমন্ডি এলাকার মৌজা দর অনুযায়ী ১ শতাংশ জমির দাম ৪৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ধানমন্ডির কোথাও এ দামে জমি বেচাকেনা হয় না।
জমি নিবন্ধনে বর্তমানে জমির ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি দেড় শতাংশ, নিবন্ধন মাশুল ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ৩ শতাংশ এবং এলাকাভেদে ১ থেকে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হয়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচা হলে যোগ হয় আরও ৪ শতাংশ উৎসে কর।
নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জমি নিবন্ধন থেকে সরকার বছরে সাত হাজার থেকে আট হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। বাজারমূল্য পদ্ধতি করা হলে এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ বিষয়ে চারটি বৈঠক করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জমির প্রকৃত বাজারদর ও মৌজা দরের তারতম্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে জানিয়ে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে একটি চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী গত ১৫ জুন সরকারি ক্রয় কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বর্তমানে প্রতিটি মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেওয়া আছে, এর চেয়ে বেশি দামে নিবন্ধন করা যাবে না। কালোটাকা সেখানেই সৃষ্টি হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বাজারভিত্তিক জমি নিবন্ধনপদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। কাজটা করার বিষয়ে আমরা এবার বদ্ধপরিকর। এতে সরকারের আয় বাড়বে, মানুষের ভোগান্তি কমবে এবং অপ্রদর্শিত আয়ের উৎস কমবে।’