পেঁয়াজ আর দামি হাতব্যাগ যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় বর্তমান সংকট ডেকে এনেছে

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলকে অভিশংসনের দাবিতে সিউলের রাজপথে বিক্ষোভ। সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া, ০৪ ডিসেম্বরছবি: এএফপি

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক–ইওল প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং–হিউনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে চৌ বাইয়ুং–হাইউকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি সৌদি আরবে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রদূত। সামরিক আইন জারি করার পর তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে দেন।

ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিম বুধবার তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, সামরিক আইন জারি করার পেছনে তিনি ছিলেন অন্যতম কুশীলব। সরকারের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাকে বিরোধী দলগুলো অপসারণ বা ইমপিচ করার চেষ্টা করার পর প্রেসিডেন্ট ইউন চরম ব্যবস্থা নেন বলে বিরোধী সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করছেন।

বিতর্কের ঘেরাটোপে প্রেসিডেন্ট ইউন

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন ইউন। সামরিক আইন জারি করা ছিল এই বিতর্কের সর্বশেষটি। তাঁর প্রশাসন বেশ অনেকগুলো কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটিতে জড়িত ছিলেন ফার্স্ট লেডি কিম কিওন হি। গোপনে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি একজন প্যাস্টরের কাছ থেকে বিলাসী একটি ডিওর হাতব্যাগ গ্রহণ করছেন।

ওই ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর ফার্স্ট লেডির বিরুদ্ধে অনুচিত কাজের অভিযোগ ওঠে। সাধারণ মানুষ তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্টের প্রশাসন যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তারই একটি প্রতীক হিসেবে ঘটনাটিকে দেখেন সমালোচকেরা।

এই বিতর্কের সঙ্গে আরও যোগ হয়েছিল ফার্স্ট লেডির কর ফাঁকি ও শেয়ার কারসাজির অভিযোগ। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া প্রেসিডেন্টের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি করে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে বিরোধী দলগুলো উদ্যোগ নেয়। ফলে প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমে যায়।

চলতি বছরে আরও আগের দিকে সরকারের ভর্তুকি মূল্যের বাজারে যে দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল, তাকে ‘বাস্তবসম্মত’ বলে প্রশংসা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইউন। তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। অনেকে একে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির সময় প্রেসিডেন্টের মূক–বধির হয়ে পড়ার সঙ্গে তুলনা করেন। বিরোধী নেতারা এ নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছেন। একজন বলেছেন, ‘একটি পেঁয়াজই প্রেসিডেন্টের সর্বনাশ করতে পারে।’

দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনে জিতেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইউন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তাঁর ভোটের পার্থক্য ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। সেই জয়ের পর থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা একবারে তলানিতে রয়েছে। তাঁর প্রশাসনকে অনুমোদন করার হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ওঠা–নামা করছে। অতি সম্প্রতি করা এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকে তাঁর কর্মকাণ্ডকে ‘খুব খারাপ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ইউনের এতসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর স্ত্রীর কর্মকাণ্ড। সংবাদমাধ্যমের খবর, কিম কিওন হি সত্যিকার অর্থে প্রেসিডেন্টের চেয়েও কম জনপ্রিয়। তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিসন্দর্ভের জন্য চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি এমন অভিযোগও রয়েছে যে তিনি শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গেও জড়িত।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ বিরোধী দলগুলোর হাতে। প্রেসিডেন্ট যেসব আইন প্রণয়ন করতে চান, তাতে বাধা সৃষ্টি করেছে পার্লামেন্ট। এমনকি প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত বাজেটও কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে প্রেসিডেন্ট ইউনের সঙ্গে পার্লামেন্টের একধরনের উত্তেজনা চলছে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে তিনি সামরিক আইন জারি করেন।

প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন প্রেসিডেন্ট ইউনকে ইমপিচ বা অপসারণ করতে প্রস্তাব এনেছে। সামরিক আইন জারিকে ‘রাষ্টদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে দলটি। আগামীকাল শুক্রবার এ নিয়ে ভোট হতে পারে। তবে এর ফলে দেশটিতে যে রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে, তা আরও গভীর হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইউনের রাজনৈতিক দল বলেছে যে তারা ইমপিচ করার চেষ্টা প্রতিহত করবে। তবে প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের বিপক্ষে প্রতিবাদ আরও জোরালো হচ্ছে।

পতনের দ্বারপ্রান্তে ইউন

প্রেসিডেন্ট ইউনের কর্মকাণ্ডকে এখন সমর্থন করছে ২০ শতাংশেরও কম কোরীয়। ক্ষমতার স্বার্থে তাঁর বিভাজনের রাজনীতি অনেক মানুষকে বিমুখ করেছে। আর নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা পূরণ করতে না পারার কারণে তাঁর অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিম জুনিল বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট সম্ভবত বিচ্ছিন্নতা বোধ করছেন এবং তাঁর ক্ষমতা হুমকির মুখে।’

প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করার জন্য ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব ভোটাভুটিতে আসছে, পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে জন–অসন্তোষও বাড়ছে। সে কারণে এই প্রশ্ন আরও জোরদার হচ্ছে: প্রেসিডেন্ট ইউন কি বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন, নাকি তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সময় ফুরিয়ে এসেছে।