ব্যবসায়ীদের স্বপ্নের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র নিয়ে এখন শুধুই হতাশা

উদ্বোধনের আট বছর পরও চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের প্রথম ও একমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (ডব্লিউটিসি) পুরোপুরি চালু হয়নি। ২১তলা ভবনের দুই–তৃতীয়াংশই এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে এ বাণিজ্যকেন্দ্রের পেছনে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সম্প্রতি নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায়ছবি: সৌরভ দাশ

উদ্বোধনের আট বছর পরও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দেশের প্রথম ও একমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের (ডব্লিউটিসি) ২১ তলা ভবনের অর্ধেকের বেশি এখনো ফাঁকা। ভবনের ৭ তলার ওপরের তলাগুলো এখনো ফাঁকা, অনেক তলায় কোনো কাজও হয়নি। রেস্তোরাঁ, ফুডকোর্ট, ডব্লিউটিসি ক্লাবের জন্য বরাদ্দ রাখা ফ্লোরগুলোও খালি পড়ে আছে। তারকা হোটেল করার পরিকল্পনাটি এখনো কাগুজে পরিকল্পনায় বন্দী।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেশীয় বাণিজ্যের সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু হয় দেশের একমাত্র বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রটির। তবে আট বছরে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি এটি। ফলে চট্টগ্রাম চেম্বারের অধীনে থাকা বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র ঘিরে ব্যবসায়ীদের যে স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল, তা এখনো অধরা রয়ে গেছে। ফলে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রটি চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে এখন এক হতাশার নাম হয়ে গেছে।

জানা যায়, বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র চালুর জন্য ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য পদ লাভ করে চট্টগ্রাম চেম্বার। এককালীন দুই লাখ মার্কিন ডলার দিয়ে এই সদস্যপদ নেওয়া হয়। ভবনটি নির্মাণে চেম্বারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। যার আয়তন প্রায় ৬ লাখ ৭৩ হাজার বর্গফুট। প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন প্রায় ৪০ হাজার বর্গফুট। ২০০৬ সালে দেশের প্রথম বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ভবনটি চেম্বারকে বুঝিয়ে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এরপর দীর্ঘ আট বছর অতিবাহিত হলেও বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু হয়নি।

একনজরে ডব্লিউটিসি  
* ভবন ২১ তলা, নির্মাণ শুরু ২০০৬ সালে  
* ভবনের মোট আয়তন পৌনে ৭ লাখ বর্গফুট
* উদ্বোধন ২০১৬ সালে, এক–তৃতীয়াংশ ফ্লোর এখনো খালি
* এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে চেম্বারের ১৫০ কোটি টাকা
* এখন বাণিজ্যকেন্দ্রটি পরিচালনায় মাসে খরচ গড়ে ৫০–৫৫ লাখ টাকা
* ভবনের বিভিন্ন স্থান ভাড়া বাবদ মাসে আয় ৩০–৩৫ লাখ টাকা
* বাণিজ্যকেন্দ্রের পেছনে মাসে লোকসান ২০–২৫ লাখ টাকা

চেম্বার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ডব্লিউটিসি ভবন পরিচালনায় মাসে চেম্বারের খরচ হয় গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা। তার বিপরীতে ভাড়া বাবদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় হয়ে মাসে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা এই বাণিজ্যকেন্দ্রের পেছনে লোকসান গুনতে হচ্ছে চেম্বারকে।

এর মধ্যে সম্প্রতি চট্টগ্রাম চেম্বারের পুরো পরিচালনা পর্ষদ পদত্যাগ করলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ আনোয়ার পাশাকে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রশাসককে ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচিতদের কাছে নেতৃত্ব হস্তান্তরের কথা বলা হয়। এ অবস্থায় বাণিজ্যকেন্দ্রের অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

অর্ধেকের বেশি ফাঁকা

ডব্লিউটিসি ভবনের নিচতলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ধরা হয়েছে ভবনের প্রথম পর্যায়। এর ওপরে ২১ তলা পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ের ৫০ ভাগ ফাঁকা। দুটি ফ্লোর এখনো পুরোপুরি খালি পড়ে আছে। এ ছাড়া ডব্লিউটিসি ক্লাবের জন্য নির্ধারিত দুটি ফ্লোরও খালি পড়ে আছে। বর্তমানে এই ১০ তলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ভবনটির কার্যক্রম।

তিনটি বেজমেন্টসহ ভবনটির নিচতলার বড় অংশজুড়ে রয়েছে অস্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র। ২০১৬ সাল থেকে হাতে গোনা কয়েকটি মেলা অনুষ্ঠিত হয় এই প্রদর্শনী কেন্দ্রে। দ্বিতীয় তলায় শপিং মল ও ফুডকোর্ট চালুর কথা থাকলেও এখনো কিছুই হয়নি। তৃতীয় তলা দুটি ব্যাংক ও কয়েকটি শিপিং ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

চতুর্থ তলায় চট্টগ্রাম চেম্বারের কার্যালয় ও সম্মেলনকক্ষ। এ ছাড়া আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। পঞ্চম তলার প্রদর্শনী কেন্দ্রে ১৩২টি শোকেসে রপ্তানি পণ্য তুলে ধরার কথা ছিল। তবে সেখানে বর্তমানে বালু ও অসমাপ্ত কাঠামো। ছয়তলার এক পাশে মেঘনা গ্রুপের চট্টগ্রাম কার্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। এর ওপরের তলাগুলো এখনো খালি পড়ে আছে।

উদ্বোধনের আট বছর পরও চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের প্রথম ও একমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (ডব্লিউটিসি) পুরোপুরি চালু হয়নি। ২১তলা ভবনের দুই–তৃতীয়াংশই এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে এ বাণিজ্যকেন্দ্রের পেছনে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সম্প্রতি নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম চেম্বারের সচিব মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো প্রকল্প ও অবকাঠামো পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পেশাদার জনশক্তি ও নীতির ধারাবাহিকতা, যা দুই বছর মেয়াদি পরিচালনা পরিষদের পক্ষে বজায় রাখা খুবই কঠিন। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন-কাটাছেঁড়া হয়েছে বোর্ড সভাগুলোতে। সদ্য বিদায়ী কমিটি ডব্লিউটিসি ক্লাব চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে শেষমেশ তা হয়নি।

বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের অষ্টম, নবম ও দশম তলা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ডব্লিউটিসি ক্লাবের জন্য। আর ১০ থেকে ২১ তলা পর্যন্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছিল চার তারকা মানের হোটেলের জন্য। কিন্তু এখনো কোনো হোটেল চালু হয়নি। যদিও বাণিজ্যকেন্দ্রটি চালুর আগে চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বলেছিলেন, বিশ্বখ্যাত গ্র্যান্ড হায়াত তারকা হোটেল স্থাপনের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হয়নি কিছুই। না ডব্লিউটিসি ক্লাব, না তারকা হোটেল।

‘প্রত্যাশা পূরণ হয়নি’

দেশের একমাত্র বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র ঘিরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল ব্যাপক। তবে চালুর আট বছরেও ব্যবসায়ীদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রটি উদ্বোধনের সময় চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সদ্য পদত্যাগ করা সভাপতি মাহবুবুল আলম। সে সময় বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। এত বছরেও সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে মাহবুবুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন বলে জানান। এর বেশি তিনি কথা বলেননি।

২০০৩-০৪ সালে ডব্লিউটিসি তৈরির প্রাথমিক প্রস্তাব দেওয়ার সময় চেম্বারের দায়িত্বে ছিলেন আমীর হুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের ট্রেড সেন্টার ঘুরে তখন আমরা একটি প্রাথমিক নকশা দিয়েছিলাম। তাতে ওপরের দিকে টুইন টাওয়ারের মতো করে একটিতে অফিস ও অন্যটি হোটেল বা বিক্রয়কেন্দ্র করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেটি আর মানা হয়নি। একটি বাণিজ্যিক ভবনের মতো করেই এটি করা হয়েছে।’