টাকা নিয়েও শেষ করেন না গবেষণা, কেউ আবার লাপাত্তা
বন বিভাগের সমাজবিজ্ঞানী আমিনুল ইসলাম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের একটি এমফিল গবেষণার জন্য মনোনীত হন ২০২১ সালে। গবেষণার প্রথম কিস্তির অর্থ হিসেবে ২০২১ সালে ১৫ জুন ৮০ হাজার টাকা নেন। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারির মধ্যে গবেষণাটি শেষ করার কথা ছিল।
কিন্তু আরও ছয় মাসের বেশি পার হয়ে গেলেও আমিনুল ইসলাম গবেষণাটি শেষ করতে পারেননি। অর্থাৎ আড়াই বছরেও এই গবেষণা শেষ হয়নি। তাঁকে কয়েকবার তাগাদাও দেওয়া হয়েছিল। পরে ছয় মাস অপেক্ষা করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদে প্রথম কিস্তির টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য নোটিশ দেয়। ৬ জুলাই এই টাকা ফেরত দেন আমিনুল ইসলাম। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল ২ লাখ টাকা।
আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, কোভিডসহ বিভিন্ন কারণে তিনি সময়মতো গবেষণা শেষ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘গবেষণাটি শেষ করতে আমি সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিলাম। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সময় বাড়ানোর আবেদন নাকচ করে দেয়, তাই আমি টাকা ফেরত দিয়েছি।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ প্রতিবছর ৪০-৫০ জন গবেষককে সমাজবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য শ্রেণিভেদে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা দেয়। কিন্তু অনেকেই গবেষণা শেষ করতে পারেন না। বারবার তাগাদা দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে অর্থ ফেরত নিতে হয়। প্রতিবছর ৮-১০ জনের কাছে অর্থ ফেরত নেওয়া হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আবার অনেক গবেষককে তাগাদা দেওয়ার পরও তাঁদের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায় না। তাঁরা লাপাত্তা হয়ে যান। এমন একটি ঘটনার কথা জানা গেছে নিউরো ডেভেলপমেন্ট মেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্টের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহ আলম। তিনি ২০১০ সালে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে পিএইচডি গবেষণার জন্য সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এ জন্য ওই বছরের এপ্রিল মাসে ৫০ হাজার টাকার একটি চুক্তি হয়। প্রথম কিস্তিতে তিনি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নেন।
বন বিভাগের সমাজবিজ্ঞানী আমিনুল ইসলাম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের একটি এমফিল গবেষণার জন্য মনোনীত হন ২০২১ সালে। কিন্তু আমিনুল ইসলাম গত আড়াই বছরে গবেষণাটি শেষ করতে পারেননি। গত ৬ জুলাই প্রথম কিস্তির ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেন আমিনুল ইসলাম।
কিন্তু ১৩ বছরেও গবেষণাটি শেষ করেননি মো. শাহ আলম। এমনকি গত কয়েক বছরে আটবার তাগাদাপত্র দেওয়ার পরও কোনো উত্তর পায়নি সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ। এমনকি শাহ আলম নিজেও কোনো যোগাযোগ করেনি। একদম লাপাত্তা হয়ে গেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব করা সম্ভব হয়নি। খুদে বার্তা দিয়েও জবাব মেলেনি।
কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে অনেকেই গবেষণা প্রতিবেদন জমা না দিয়েই বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছেন। এসব কারণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের কার্যকারিতাও অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার গবেষণা করার জন্য বরাদ্দকৃত টাকার পরিমাণও কম। ফলে গবেষকদের আগ্রহও থাকে কম।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণা খাতে প্রতিবছর কত খরচ হয়, গবেষণা ঠিকমতো হয় কি না, গবেষণার মান কেমন—এসব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির জন্য নির্দেশ দিয়েছি। অনেক অর্থ ফেরত আসছে। অনেকে গবেষণার জন্য টাকা নিয়ে গবেষণা শেষ করতে পারছেন না। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার সিদ্ধান্ত নেব, গবেষণা খাতে বরাদ্দ কীভাবে বাড়াব।’
গবেষণায় বরাদ্দ কমছে
সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের বরাদ্দ বেশ অপ্রতুল। গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বরাদ্দ কমছে। চলতি অর্থবছরে মাত্র ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) সব মিলিয়ে ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। ওই বছর ৪৯টি গবেষণা কর্মসূচি চলে।
এর আগের বছর ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে ২০২০ সালে কোভিডের বছর গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা অর্থের মধ্যে খুব কম অর্থ খরচ হয়েছিল।
সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের তথ্যে দেখা গেছে, গবেষণা খাতে বছরে বরাদ্দ গড়ে ২ কোটি টাকার কিছুটা বেশি। ৪০-৫০টি গবেষণার জন্য এই বরাদ্দ থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি গবেষণায় গড় ৫ লাখ টাকার মতো। জানা গেছে, ১৯৮৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৯৪টি গবেষণা শেষ হয়েছে।
আবার অনেকে যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে গবেষণার সময়ও বাড়িয়ে নেন। যেমন সাত বছর আগে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে গবেষণা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরে ছয় বছরেও তিনি গবেষণা শেষ করতে পারেননি। গত অর্থবছরে বারবার তাগাদা দেওয়ার পর তিনি গবেষণাটি শেষ করেন। গবেষণার জন্য তাঁকে ছয় লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল।
মো. শাহ আলম ২০১০ সালে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে পিএইচডি গবেষণার জন্য সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এ জন্য ওই বছরের এপ্রিল মাসে ৫০ হাজার টাকার চুক্তি হয়। প্রথম কিস্তিতে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নেন তিনি। গত ১৩ বছরেও গবেষণাটি শেষ করতে পারেননি। এখন তাঁর খোঁজ মিলছে না।
আরেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা চার বছর আগে একটি গবেষণার জন্য প্রথম কিস্তির টাকা হাতে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ায় পর তিনি গবেষণাটি শেষ করতে পারেননি। পরে অর্থ ফেরত দেন তিনি। আরও একজন সরকারি কর্মকর্তা গবেষণা শেষ করতে পারেননি, কারণ বদলি হয়ে যাওয়ায় তাঁর ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল।
সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ পাঁচ শ্রেণিতে গবেষণা করার জন্য টাকা দেয়। এগুলো হলো তরুণ গবেষকদের জন্য প্রমোশনাল গবেষণা; ফেলোশিপ গবেষণা; প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা; এমফিল গবেষণা এবং পিএইচডি গবেষণা। প্রতিবছর গড়ে আড়াই শর বেশি আবেদন জমা পড়ে। নির্বাচিত গবেষক ও সংস্থাকে শ্রেণিভেদে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়।