চা উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না, আমদানি লাগবে না বলে দাবি উৎপাদকদের
এবার উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি চা। লক্ষ্য পূরণে নভেম্বর–ডিসেম্বরে ৩ কোটি ১৩ লাখ কেজি উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত বছরের শেষ দুই মাসে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড ১ কোটি ৯৮ লাখ কেজি।
দেশে বছরে চায়ের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৯ কোটি কেজি।
দেশে চলতি বছরে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। গত অক্টোবর পর্যন্ত উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও উৎপাদকেরা লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশে ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৭ কোটি ৬৬ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ৩ কোটি ১৩ লাখ কেজি চা উৎপাদন হতে হবে। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত বছরের শেষ দুই মাসে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৯৮ লাখ কেজি চা উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দুই মাসে ১ কোটি ১৫ লাখ কেজি চা বেশি উৎপাদন করা দরকার, যেটাকে অসম্ভবই মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তবে বাগানমালিক, ব্যবসায়ী ও চা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, উৎপাদন আশানুরূপ না হলেও দেশে চায়ের ঘাটতি হবে না। কারণ, গত বছরে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হয়েছে। রপ্তানির পর উদ্বৃত্ত থাকা চা দিয়ে ঘাটতি পূরণ করা যাবে। ফলে উৎপাদন কিছুটা কমলেও আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না।
টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শাহ মঈনুদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গতবারের তুলনায় উৎপাদন কিছুটা কমলেও চা আমদানি করতে হবে না। কারণ, চায়ের চাহিদাও কমেছে।
চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম হলো জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস। এ সময়ে প্রতি মাসে এক কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদিত হয়। আর চা চাষের জন্য প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টি। কিন্তু এবার বিরূপ আবহাওয়া ও বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে ফলন আশানুরূপ হয়নি বলে জানান উৎপাদকেরা।
জানতে চাইলে চা–বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরান টি রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চা চাষের জন্য অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি দুটোই ক্ষতিকর। এবার আবহাওয়া চা চাষের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে উৎপাদন কমেছে।
দেশের ইতিহাসে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ লাখ কেজি বেশি। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে চায়ের চাহিদা কমবেশি সাড়ে ৯ কোটি কেজি। অন্যদিকে, চা বোর্ডের হিসাবে অবশ্য চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি।
সরবরাহ কমেছে, দাম বেড়েছে
এদিকে গত বছরের তুলনায় উৎপাদন কমায় নিলামে চায়ের সরবরাহ কমেছে। চা বেচাকেনায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্রোকার্সের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি মৌসুমের ৩০টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ কেজি। গত বছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ কেজি। সেই হিসাবে গতবারের তুলনায় বিক্রি কমেছে ২১ লাখ ৭৫ হাজার কেজি।
নিলামে সরবরাহ কমায় চায়ের দাম বেড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ৩০টি নিলামে প্রতি কেজি চা বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা ৫৬ পয়সায়। গত বছর একই সময়ে প্রতি কেজি গড়ে ১৯২ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। অর্থাৎ, কেজিতে চায়ের গড় মূল্য সাড়ে ১৮ টাকা বেড়েছে।
চা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, চা–বাগান ও ক্ষুদ্র চাষিদের উৎপাদিত চা নিলামে বিক্রি করতে হয়। বাগানমালিকেরা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ চা কর দিয়ে নিজেরা প্যাকেটজাত বা রপ্তানির জন্য সংগ্রহ করতে পারেন। নিলামে চায়ের গুণগতমান ও সরবরাহের পরিমাণ দেখে দর হাঁকান ক্রেতারা।
গত বছর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হলেও চায়ের ভালো দাম পাননি বাগানমালিকেরা। সে জন্য দরপতন ঠেকাতে এ বছরের এপ্রিলে চা বোর্ড চায়ের নিলামে শেয়ারবাজারের মতো ফ্লোর প্রাইস বা ন্যূনতম নিলাম মূল্য বেঁধে দেয়। তাতে নিম্নমানের চা বিক্রি না হওয়ায় নিলামে গড় মূল্য বেড়েছে। উৎপাদকেরা বলছেন, গড় দাম কিছুটা বাড়লেও চায়ের উৎপাদন খরচ এখনো বেশি। অনেক বাগানের চা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে নিলামে বিক্রি করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরান টি রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর প্রতি কেজি চায়ের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২২৬ টাকা। এবার আরও বাড়বে। নিলামে গড় মূল্য বাড়লেও এখনো উৎপাদন খরচের তুলনায় কমে চা বিক্রি হচ্ছে। এবারও বেশির ভাগ বাগান লোকসানে থাকবে। এ জন্য নিলামে ন্যূনতম মূল্য সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামের পাইওনিয়ার বাগানে চা চাষ শুরু হয়েছিল। বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাবের আশপাশের এলাকায় ছিল ওই বাগানের অবস্থান। সেই বাগানে প্রথম চা উৎপাদিত হয় ১৮৪৩ সালে। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয় সিলেটের মালনীছড়ায়। বর্তমানে দেশে মোট ১৬৯টি চা–বাগান রয়েছে।