চট্টগ্রাম বিমানবন্দর
এক মাসে এল এক টন সোনা
শুধু নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে ৫ হাজার যাত্রী এক টনের সমপরিমাণ সোনার বার এনেছেন। অক্টোবরে এসেছিল ২৫৯ কেজি।
করোনার মধ্যে বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সোনার বার আনার ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। বৈধ পথে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সরকারকে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনার বার আনছেন প্রবাসীরা। গত নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় এক টনের সমপরিমাণ সোনার বার এসেছে। পাঁচ হাজার যাত্রী এসব সোনার বার এনেছেন। বাজারমূল্যে এসব সোনার বারের দাম প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা। এক মাসে এত বিপুল পরিমাণ সোনার বার আসার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ সোনা ব্যবসায়ীরা।
করোনার কারণে সোনার দোকানে এখন বেচাকেনা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। যাত্রীরা যেসব সোনার বার নিয়ে আসছেন, সেগুলো সোনার দোকানে আসছে না। তাই আমাদের ধারণা, মূলত ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এসব বার আনা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বপন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে সোনার দোকানে এখন বেচাকেনা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। যাত্রীরা যেসব সোনার বার নিয়ে আসছেন, সেগুলো সোনার দোকানে আসছে না। তাই আমাদের ধারণা, মূলত ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এসব বার আনা হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বৈধভাবে শুল্ক-কর দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ ভরি বা দুটি সোনার বার আনতে পারেন। এ জন্য প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) শুল্ক-কর দিতে হয় ২ হাজার টাকা। সোনার বারের বাইরে ১০০ গ্রাম ওজনের (প্রায় সাড়ে আট ভরি) স্বর্ণালংকার আনতে পারবেন বিনা শুল্কে। ২০১৮ সালের আগে ব্যাগেজ রুলের বাইরে দেশে বৈধ পথে সোনা আমদানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ২০১৮ সালে সরকার সোনা নীতিমালা করে। এ নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা আমদানি করে আসছে। স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় গত এক বছরে ২৫ কেজি সোনা আমদানি করেছে দুটি প্রতিষ্ঠান। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমদানির জন্য আবেদন করেছে। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে সোনা ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ সোনা আমদানি করেছেন, তার চেয়ে ৪৩ গুণ বেশি সোনা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে এক মাসে এনেছেন প্রবাসীরা। নভেম্বর মাসে এ বিমানবন্দর দিয়ে ৯৩ হাজার ৬৭০ ভরির সমপরিমাণ ৯ হাজার ৩৬৭টি সোনার বার এসেছে, কেজির হিসাবে যার পরিমাণ ১ হাজার ৯২ কেজি বা এক টনের বেশি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নজরদারি বৃদ্ধির কারণে অবৈধ পথে দেশে সোনা আনার ঘটনা কমেছে। তার বিপরীতে বৈধ পথে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আমদানি বেড়ে গেছে। বৈধভাবে সোনা আনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এসব সোনা দেশে থাকছে কি না। রেকর্ডপত্রের তথ্য অনুযায়ী অতীতে কখনো ব্যাগেজ রুলের আওতায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে এক মাসে এত বেশি সোনার বার আসেনি।
কাস্টমস সূত্র জানায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরোটা সময়ে এ বিমানবন্দর দিয়ে সব মিলিয়ে ১০৪ কেজির বেশি সোনার বার এনেছিলেন যাত্রীরা। করোনার কারণে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত আকাশপথে কোনো সোনার বার আনার সুযোগ ছিল না। গত সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক পথে উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হওয়ার পর সোনা আনার হিড়িক পড়ে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যেসব প্রবাসী দেশে আসছেন, তাঁদের কেউই যেন সোনার বার ছাড়া ফিরছেন না। গত সেপ্টেম্বরে প্রায় পৌনে চার কেজি ওজনের সমপরিমাণ সোনার বার এনেছেন যাত্রীরা। অক্টোবর মাসে আনা হয়েছে ২ হাজার ২২৪টি সোনার বার, যা ২২ হাজার ২৪০ ভরি বা ২৫৯ কেজির সমান। এটিই ছিল রেকর্ড। গত মাসে সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সহকারী কাস্টমস কমিশনার মুনাওয়ার মুরসালীন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় মূলত দুবাইফেরত চট্টগ্রাম অঞ্চলের যাত্রীরা এসব সোনার বার নিয়ে আসছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীরা আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা ব্যবহার করে দুটি সোনার বার নিয়ে আসছেন। গত মাসে আসা সোনার বার থেকেই শুধু ১৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা রাজস্ব পাওয়া গেছে। অতীতে এক বছরেও এত রাজস্ব পাওয়া যায়নি।
ব্যাগেজ রুলের আওতায় মূলত দুবাইফেরত চট্টগ্রাম অঞ্চলের যাত্রীরা এসব সোনার বার নিয়ে আসছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীরা আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা ব্যবহার করে দুটি সোনার বার নিয়ে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশ থেকে যাঁরা সোনার বার নিয়ে আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই প্রবাসী শ্রমিক। একেকজন শ্রমিকের পক্ষে ২০ ভরি ওজনের বা প্রায় ১২ লাখ টাকা দামের সোনার বার আনার বিষয়টি তাঁদের জীবনযাপন ও আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এসব সোনার বার চোরাচালান হয়ে প্রতিবেশী দেশে যাচ্ছে বা অবৈধ লেনদেনে ব্যবহার হচ্ছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের সোনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেজি কেজি সোনা দেশে এলেও তা সোনা ব্যবসায়ীদের হাতে যাচ্ছে না। তাই তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, এত সোনা তাহলে যাচ্ছে কোথায়? সোনা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেউ ব্যক্তিগত ব্যবহার বা বিক্রির জন্য এসব সোনার বার আনলে তা অলংকার তৈরির জন্য সোনা ব্যবসায়ীদের হাতে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই সময়ে যাত্রীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিপুল পরিমাণ সোনা আনার ঘটনা অস্বাভাবিক। সোনা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে, তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। যাঁরা আনছেন, তাঁরা আয়কর নথিতে সম্পদ হিসেবে দেখাচ্ছেন কি না বা বিক্রি করলে রসিদ আছে কি না, এসব বিষয় অনুসন্ধান করলে সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসবে।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই সময়ে যাত্রীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিপুল পরিমাণ সোনা আনার ঘটনা অস্বাভাবিক। সোনা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে, তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।