শেয়ারবাজারের জুয়াড়ি ধরতে ছয় মাস থেকে এক বছর লাগে
শেয়ারবাজারের একজন জুয়াড়ি ধরতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘স্টক এক্সচেঞ্জ দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দিলে আমরা তাঁদের ধরতে পারি। তারপর নিয়ম অনুযায়ী তথ্যপ্রমাণ যাচাই-বাছাই করে শাস্তি দিতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লেগে যায়। ততক্ষণে বিনিয়োগকারী ও বাজারের যা ক্ষতি করার তা করে ফেলেন তাঁরা।’
শেয়ারবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসইসি চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে সিএমজেএফ সভাপতি জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিলে সভাপতিত্ব করেন বিএমবিএ সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান। এতে আলোচকেরা দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংকের পরিবর্তে পুঁজিবাজারকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
আলোচনায় অংশ নেন পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিলের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, বিএসইসির সাবেক দুই চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ও এম খায়রুল হোসেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. জাহিদ হাসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. এজাজুল ইসলাম, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হেলাল, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, আইসিএবির কাউন্সিল সদস্য গোপাল চন্দ্র ঘোষ, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হাসান ইমাম এবং ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও।
বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে বিশ্লেষকেরা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু উন্নত দেশে ঋণ ও সঞ্চয়ের সুদহার ১ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। জাপানে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখলে তাঁর অর্থ কেটে রাখা হয়। ঋণ নিলে সুদ দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশ। সেখানে মানুষ ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় শেয়ারবাজারে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে অবস্থা উল্টো। এখানে আমানতের সুদ ৭ শতাংশের কাছাকাছি। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিও ৬ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে মানুষ শেয়ারবাজারে যেতে চায় না।’ ভারতে ৪০ কোম্পানির শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেসভ্যালু) নিচে। তাঁর প্রশ্ন, বাংলাদেশে কতটি কোম্পানি বন্ধ? কতটি কোম্পানি বাজার থেকে বিদায় নিয়েছে? তিনি বলেন, সমালোচনা করতে হবে ভালোর জন্য। তার আগে বাস্তবতা বুঝতে হবে।
বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, তখন একভাবে চিন্তা করতাম। আর যখন মাঠে এসেছি, দেখছি বইয়ে লেখা নিয়মকানুন সব জায়গায় পালন করা যায় না। বাস্তবতার নিরিখে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি অনেক কিছুই করতে চাই, কিন্তু সম্ভব নয়। কারণ, অনেক কিছুই প্রস্তুত নয়।’
সরকারি কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়ে শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের যেকোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সব সময় সচেতন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চাচ্ছেন সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে আনতে, কিন্তু কোম্পানিগুলোর পর্ষদ চায় না। এসব কোম্পানির পরিচালনায় গতিশীলতা আনতে পর্ষদগুলো ভেঙে দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নতুন পণ্য চালু করতে চাই। কিন্তু দক্ষ লোকের খুবই অভাব। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তুত থাকলে এ মাসেই সেকেন্ডারি বাজারে সরকারি সিকিউরিটিজ চালু হবে। এতে বাজার মূলধন জিডিপির ২৫ শতাংশে চলে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর যেভাবে সহযোগিতা করছে, তাতে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা শক্তিশালী বন্ড মার্কেট দেখতে পাব।’
সাবেক দুই চেয়ারম্যান যা বললেন
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করেন। এখানে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাঁদের আরও সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লাভ হলেই একসঙ্গে সব বিক্রি করে দেওয়া ঠিক নয়।
শেয়ারবাজারে অনেক দুর্বলতা আছে মন্তব্য করে খায়রুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন অনেক কম। শিল্পায়নে ব্যাংকের তুলনায় শেয়ারবাজার থেকে কম অর্থায়ন হয়। কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। একটি দেশের শেয়ারবাজারের উন্নয়নে ১০ থেকে ১২টি বিষয়ের দরকার আছে। এর মধ্যে আইনকানুন অন্যতম। আইনকানুন আমাদের আছে।’
বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ভালো কোম্পানি বাজারে আসছে না। এর অনেক কারণ আছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে সচেতনতা নেই। কারণ তাঁদের ধারণা এ বাজারে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক থেকে সহজেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো পরিশোধও করতে হয় না। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করহারের ব্যবধান কম।
খায়রুল হোসেন বলেন, নিজের পুঁজির সুরক্ষা বিনিয়োগকারীকেই দিতে হবে। বিশ্বের কোথাও নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) দর নির্ধারণ করে না। কোম্পানি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দাম নির্ধারণ করে।
শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় দরকার, এমন মত দিয়ে বিএসইসির এই সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, আইডিআরএ, বিটিআরসি, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়, সেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
বিএসইসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ভালোভাবে কাজ করছে না। কারণ, শিল্পায়নে ৯০ শতাংশ পুঁজি ব্যাংক থেকে আসে। ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করছে। এরপর ঋণখেলাপি বাড়ছে। সেই ঋণ আবার অবলোপন হচ্ছে। কোম্পানি ভালো হলে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংক বাসায় চলে যায়।
শেয়ারবাজারের বিকাশে ব্যাংকে সুশাসন জরুরি, এমন মন্তব্য করে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এখানে ভালো কোম্পানি কম। ভালো কোম্পানি বাড়াতে হবে। তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করের পার্থক্য বাড়ানো অন্যতম। কিন্তু পার্থক্য বাড়ালেও কোম্পানি আসবে না। মূল কথা, বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে আইন বাস্তবায়নের সক্ষমতা কম। এ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
১৭ কোটি মানুষকে কি তারা মূর্খ মনে করে
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আসতে বাধ্য করতে হবে। কারণ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কত টাকা কর দেয়, তা সবাই জানেন। তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু ইউনিলিভার ও নেসলে বাংলাদেশ দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা কত টাকা কর দেয়, তা কেউ জানেন না। কারণ, তারা তালিকাভুক্ত নয়।
আবু আহমেদ বলেন, ‘ইউনিলিভারের সাবান লাক্স, নেসলের নুডলস কিনছি। তারা ব্যবসা করে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের মালিকানা দিচ্ছে না। তারা কেন তালিকাভুক্ত হচ্ছে না? আমরা যখন বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের দিকে দেখি, তখন শীর্ষ দশে (টপ টেন) ইউনিলিভার ও নেসলে থাকে। তাহলে আমাদের এখানে নেই কেন? ১৭ কোটি মানুষকে কি তারা মূর্খ মনে করে? এ প্রশ্নের জবাব জানতে হবে।’
আবু আহমেদ আরও বলেন, তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান আগে ১০ শতাংশ থাকলেও এখন তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ পার্থক্য কমপক্ষে ১৫ শতাংশ থাকা উচিত।